উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়ি জনপদ আজ দুঃখ আর শোকের মেঘে ঢেকে আছে। প্রতিটি ঘর যেন একেকটি ভাঙা গল্প। কেউ তার বাবাকে হারিয়েছে, কেউ ছেলেকে। কোনো মা তার অপহৃত সন্তানের অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছে; কেউবা জানে, মুক্তিপণ দিতে না পারার কারণে তার প্রিয়জন আর ফিরে আসবে না।
গত এক বছরে ১৮৭ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। যারা ফিরে এসেছেন, তারা যেন এক ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আর যারা ফিরে আসেননি, তাদের পরিবারের কান্নার শব্দ থামছে না। এক মায়ের কথা ভাবুন, যিনি তার তরুণ ছেলেকে হারিয়েছেন। অপহরণের পর মুক্তিপণ চেয়েছিল সন্ত্রাসীরা। গরিব মা সব কিছু বিক্রি করেও টাকা জোগাড় করতে পারেননি। কিছুদিন পর খুঁজে পাওয়া গেল তার ছেলের নিথর দেহ।
এক বাবা বলেন, “ছেলেটা ছিল আমাদের একমাত্র আশা। পড়াশোনা করে একদিন বড় হবে, আমাদের এই দারিদ্র্যের অন্ধকার থেকে টেনে তুলবে। কিন্তু এখন সব শেষ। এখন আমার স্ত্রী দিনরাত কাঁদে। আমি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাই না।”
মানবিকতার করুণ আর্তনাদ
এই অপহরণের ঘটনাগুলো শুধু আর্থিক ক্ষতির গল্প নয়, বরং মানবতার এক নির্মম ট্র্যাজেডি। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা শুধু মানুষ অপহরণই করছে না, বরং মানুষের জীবন থেকে সুখ, শান্তি, এবং নিরাপত্তার অনুভূতিটুকুও ছিনিয়ে নিচ্ছে। যে ছেলেকে একদিন আদরে বড় করেছেন, তার হাত-পা কাটা নিথর দেহ যখন বাড়িতে ফেরে, তখন সেই পরিবার আর বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পায় না।
তরুণদের জাগরণ: মানবতার শেষ আশ্রয়
এই সংকটের মধ্যে টেকনাফ ও উখিয়ার কিছু সাহসী তরুণ নিজেদের এগিয়ে এনেছে। তারা কেবল প্রতিবাদ করছে না; তারা একটি ধ্বংসপ্রায় জনপদে নতুন আশার আলো জ্বালানোর চেষ্টা করছে। ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জাতীয় প্রেস ক্লাবে তারা মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। এই মানববন্ধন ছিল দুঃখে ডুবে থাকা জনপদের মানুষগুলোর পক্ষে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ।
মানববন্ধনে বক্তারা যখন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তখন তা শুধু ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। এটি ছিল একটি ব্যথিত জনপদের আর্তি। ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল তাদের সাহসের প্রশংসা করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, পুলিশের ভূমিকা আরও কার্যকর হবে।
প্রশাসনের প্রতি আবেদন: দায়িত্ব পালনই সমাধান
এই সংকট থেকে উত্তরণে প্রশাসনের আন্তরিক উদ্যোগ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
১. পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নির্মূলের জন্য যৌথ অভিযান শুরু করতে হবে।
২. প্রতিটি অপহরণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৩. রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজরদারি বাড়াতে পুলিশি চৌকি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
৪. ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য জরুরি আর্থিক সহায়তা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. প্রতিটি এলাকায় নিয়মিত টহল এবং স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
আমাদের দায়িত্ব: মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো
এই সংকটে শুধু প্রশাসন নয়, সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে একসঙ্গে রুখে দাঁড়াই, তবেই এই অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাওয়া সম্ভব।
শুধু ভাবুন, যদি আজ এই ব্যথা আপনার পরিবারে হতো? যদি আপনিও আপনার প্রিয়জনকে এভাবে হারাতেন? আমরা কি তখন চুপ থাকতে পারতাম?
উখিয়া-টেকনাফের এই কান্না কেবল একটি অঞ্চলের নয়, এটি পুরো জাতির বিবেকের সামনে একটি প্রশ্ন। আমরা কি এই কান্না শুনে চোখ বন্ধ করে থাকব? নাকি এক হয়ে এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াব?
তাদের কান্না আমাদের জাগাক। তাদের হারানোর গল্প আমাদের বাধ্য করুক, সঠিক পথে এগিয়ে যেতে। একমাত্র সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দায়িত্বশীলতা দিয়েই আমরা এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাব।
লেখকঃ শাহ্ মুহাম্মদ রুবেল
নির্বাহী সম্পাদক
দরিয়া নগর ডটকম