মিঠে কড়া সংলাপ; আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী?

জাতীয় রাজনীতি

আমাদের দেশের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর কথা নতুন করে মনে পড়ে গেল। শৈশবেই ক্ষুদিরাম বসুর আত্মত্যাগের বিষয়টি আমার পিতার মুখে শুনেছিলাম। অবসর সময়ে, বিশেষ করে সন্ধ্যারাতে প্রায়ই তিনি ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানটি সুর করে গাইতেন। সে সময়ে তার কণ্ঠে শোনা সেই গানটির মাধ্যমেই ক্ষুদিরাম বসুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তারপর আমার পিতার মুখে তার ফাঁসিতে ঝোলার প্রেক্ষাপট শোনাসহ পরবর্তীকালে বিভিন্ন বইপুস্তক, পত্রিকা পাঠ করে তার সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনেছিলাম। জেনেছিলাম ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য তার মতো আরও শত শত শহিদের আত্মত্যাগের কথাও।

ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মোহবনী গ্রামে। ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর অতি অল্প বয়সেই ভারতমাতৃকার স্বাধীনতার মানসে তিনি অনুশীলন সমিতি নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। সে সময়ে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার জন্য পাইকারি হারে গ্রেফতারসহ বিপ্লবীদের ওপর অন্যায়ভাবে জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন চালাতেন এবং এসব কাজে বিচার বিভাগকেও ব্যবহার করতেন। সে অবস্থায় ক্ষুদিরাম বসু প্রফুল্ল চাকি নামে আরও একজন বিপ্লবীর সঙ্গে ব্রিটিশ বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করেন। কিন্তু তাদের সে বোমা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অন্য একটি গাড়িতে পড়ায় সেই গাড়ির দুজন ব্রিটিশ মহিলার মৃত্যু হয়, যারা ছিলেন মিসেস কেনেডি এবং তার কন্যা। সে ঘটনায় প্রফুল্ল চাকি গ্রেফতারের আগেই আত্মহত্যা করলেও ক্ষুদিরাম বসু গ্রেফতার হন এবং বিচারে তার ফাঁসির আদেশ হয়।

ফাঁসি হওয়ার সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন, যা তাকে ভারতের কনিষ্ঠতম বিপ্লবী অভিধায় অভিষিক্ত করেছিল। আর সেই দুজন নবীনের আত্মত্যাগের ঘটনায় ভারতজুড়ে তীব্র আন্দোলনসহ আওয়াজ উঠেছিল, ‘অবিলম্বে স্বরাজ চাই’!

আজ এতদিন পর নতুন করে সেসব ইতিহাস মানসপটে ভেসে ওঠার বিশেষ কারণটি হলো, আমাদের দেশে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলন; যে আন্দোলনে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ থেকে শুরু করে স্কুলের শিশু-কিশোররাও অংশ নিয়ে তা ছাত্র-জনতার বিপ্লবে পরিণত করেছিল। ফলে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে দীর্ঘকালের স্বৈরশাসনের ভিত ধ্বংস হয়ে আমাদের দেশমাতৃকা অপশাসনের শৃঙ্খলমুক্ত হয়।

এ অবস্থায়, আজ এ মুহূর্তে আন্দোলনে শহিদ ছাত্র-জনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের শহিদ ক্ষুদিরামের চেয়ে এসব শহিদের আত্মত্যাগও কিন্তু কোনো অংশে কম নয়! পার্থক্য শুধু এতটুকু, ক্ষুদিরামকে লড়তে হয়েছিল ব্রিটিশ দখলদারদের বিরুদ্ধে আর আবু সাঈদদের লড়তে হয়েছে আমাদের নিজ দেশের একনায়কের বিরুদ্ধে!

ক্ষুদিরামের পাশাপাশি এখানে আবু সাঈদের নামটি এসে গেল, কারণ ক্ষুদিরাম যেমন কনিষ্ঠতম বিপ্লবী হিসাবে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ভারতবর্ষের সর্বত্র বিপ্লবের আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন, আমাদের দেশেও সেদিন ১৬ জুলাই রংপুরের আবু সাঈদ বন্দুকের নলের মুখে বুক পেতে দিয়ে প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে দেশের মানুষের মনে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন; ফলে সারা দেশে দাবানলের মতো একদফার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। আবু সাঈদ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন এবং অন্য আর দশজনের মতো পড়ালেখা শেষে কাজকর্ম, আয়-রোজগার করে তিনিও তার পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু না, দেশের প্রয়োজনে একজন ছাত্র হিসাবে তিনি চুপচাপ বসে থাকতে পারেননি; ছাত্র আন্দোলনে শামিল হয়ে বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন, অন্যায়, অত্যাচার সহ্য করে মুখে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে থেকে শুধু শুধু বেঁচে থাকার নামই জীবন নয়, দেশের প্রয়োজনে, দেশ রক্ষার প্রয়োজনে সাহসের সঙ্গে অন্যায়, অবিচারের মুখোমুখি হওয়ার নামই জীবন। আর তাই তিনি তেমন জীবনই বেছে নিয়ে অমর হয়ে রইলেন। যেমনটি আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন ব্রিটিশ আমলের ক্ষুদিরাম বসু; ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের লাখো শহিদ, তেমনি আবু সাঈদও একজন শহিদ মুক্তিসংগ্রামী এবং সেই সঙ্গে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের একেকজন শহিদ, তারাও মুক্তিসংগ্রামী। কারণ, যেভাবে জগদ্দল পাথরের মতো স্বৈরাচারী একনায়ক দেশ ও জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল, যেভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকিয়ে দিয়ে অফিস-আদালতসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পর্যন্ত কলুষিত করে সবাইকে কায়েমি স্বার্থবাদী করাসহ স্বৈরাচারের আজ্ঞাবাহী করে ফেলা হয়েছিল, সে অবস্থায় আবু সাঈদের মতো শত-সহস্র বিপ্লবী ছাড়া তাদের সরানো সহজসাধ্য ছিল না।

এখানে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনে যখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ আসনসহ ২৩৪টি আসনে জয়লাভ করলেন এবং সেই নির্বাচনে বিরোধী দলের কোনো একটি দলও অংশগ্রহণ না করে নির্বাচনের নামে প্রহসন অনুষ্ঠানের কথা বললেন এবং তারপরও বিরোধী দল দমনের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৮ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকলেন এবং অতঃপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আবার কারচুপি করে দিনের ভোট রাতে অর্থাৎ ভোটের আগের দিন রাতে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করলেন এবং সে অবস্থায় বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে আর কোনো নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অংশগ্রহণ করবেন না বলে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করল, সে অবস্থাতেও বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে দমনপীড়নের মাধ্যমে আবার ২০২৪ সালে একই কায়দায় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতা ধরে রাখার মানসিকতা কেমন করে হলো, তা মোটেই বোধগম্য নয়। এক্ষেত্রে একমাত্র ক্ষমতা উন্মাদ কোনো একনায়ক ছাড়া কারও পক্ষে এমন কাজটি করা সম্ভব ছিল না।

অবশেষে যা হওয়ার তা-ই হলো। সে ক্ষমতাও তিনি বা তারা ধরে রাখতে পারলেন না। গত ১৫ বছর ধরে সরকারি আমলা-কর্মচারীকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পেলেপুষে মোটাতাজা করেছিলেন, ক্ষমতা ধরে রাখার অপকৌশল হিসাবে তাদের ব্যবহার করে দেশের অগণিত ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেও শেষ রক্ষা হলো না। মাঝখানে বেনজীরের মতো ব্যক্তি নজিরবিহীন দুর্নীতি করে দেশ ছেড়ে পালালেন, বঙ্গবন্ধুকন্যাকে নিজ মুখে বলতে হলো, তার পিয়ন পর্যন্ত ৪০০ কোটি টাকার মালিক এবং সেই পিয়নও পালাল!

আমাদের মতো সাধারণ জ্ঞানের মানুষ কিছুতেই আরও যেসব ঘটনা বুঝে উঠতে পারছি না তা হলো সালমান এফ রহমান, এস আলম, আবদুল হাই বাচ্চু, পিকে হালদার-এমন আরও অনেক কুখ্যাত ব্যাংক ডাকাত, পুঁজিবাজার লুটেরা, অর্থ পাচারকারী ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার এতটা কাছের লোক হয়ে গেলেন কেমন করে? কারণ এরা সবাই তো মার্কামারা! কেউ পুঁজিবাজার ও অন্যান্য সেক্টর লুট করে দরবেশ হিসাবে খ্যাতি পেলেন, কেউ ৮/১০টি ব্যাংক কুক্ষিগত করে সেসব ব্যাংকের টাকা ডাকাতি করে ব্যাংকডাকাত হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর এত কাছের লোক হয়ে গেলেন! অথচ সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাদের জানেন না বা চেনেন না, এমন কথা তো কেউ বিশ্বাস করবেন না। তাহলে কি সাবেক প্রধানমন্ত্রী জ্ঞানত-ধর্মত জেনেশুনে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন? কারণ, সালমান এফ রহমান যে শুধু পুঁজিবাজার থেকেই হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন, সে প্রমাণও তো দেশের মানুষের নখদর্পণে। মাত্র কিছুদিন আগেও তো পুঁজিবাজারে সুকুক বন্ড ছেড়ে তিনি প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন এবং ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিকে তা ক্রয় করতে বাধ্য করেছেন। তাছাড়া বন্ডের নাম দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও প্রচুর অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে, সুকুক বন্ডে বিনিয়োগকৃত এসব অর্থ বিনিয়োগকারীরা আর ফেরত পাবেন না। তাই যদি হয়, তাহলে এসব দায়দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে? পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের এ তিন হাজার কোটি টাকাই বা কে শোধ করবেন? বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি যদি এসব টাকা ফেরতের জন্য মামলা করেন, তাহলে সালমান এফ রহমানের পাশাপাশি যদি তার আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে মামলা করেন, তাহলে কি সেসব বিনিয়োগকারীকে দোষ দেওয়া যাবে? কারণ, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয় যদি এভাবে লুট করা হয় এবং তা যদি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বেসরকারি উপদেষ্টা করে থাকেন, তাহলে দুজনের ওপরই তো সেসব অপকর্মের দায় বর্তায়।

এ অবস্থায় বলতে চাই, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সালমান এফ রহমান প্রমুখ গত ১৫ বছরে যেসব অন্যায়-অবিচার করেছেন, ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তার দায়দায়িত্ব শুধু সালমান এফ রহমান এবং বেনজীর গংদের একার নয়, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে জেনে-শুনে-বুঝে যিনি তাদের নিয়োগ দিয়ে বছরের পর বছর ধরে অপকর্মে মদদ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন, তাকেও এসব অন্যায় অপরাধের দায়ভার বহন করতে হবে।

জনান্তিকে আরও একটু বলে রাখা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসাবে শেখ হাসিনা এদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তার নিজের প্রতি, তার পিতার প্রতি এবং তার পিতার প্রতিষ্ঠিত দল ইত্যাদি কারও প্রতিই সুবিচার করতে পারেননি। নিজের খেয়াল খুশিমতো তিনি যা করেছেন, তাতে নিজের ক্ষতির পাশাপাশি তার পিতা এবং দলেরও তিনি ক্ষতি করেছেন। পিতার নাম এবং দলকে ব্যবহার করে খামখেয়ালিপনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদেরও তিনি প্রভূত ক্ষতি করে গেছেন; যা ফিরে পেতে বা সেসব ক্ষত মেরামত করতে বহু সময়ের প্রয়োজন হবে। সবশেষে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, দেশ এবং আওয়ামী লীগের আজকের অবস্থার জন্য কে বা কারা দায়ী সে বিষয়টি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে না পারলেও আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ দলটি ভবিষ্যতে আবারও সঠিক রাস্তা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হবে।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা