তারেকুর রহমান, কক্সবাজার ||
শীতের শুরুতে পর্যটকে মুখর হয়ে উঠেছে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। মিষ্টি রোদ আর শান্ত নীল সাগরের সৌন্দর্য মনের সঙ্গে মাধুরী মিশিয়ে উপভোগ করছেন তারা।
শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটিকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন হাজারো ভ্রমণপিপাসু।
সকাল-সন্ধ্যা সৈকতের সুগন্ধা, লাবণী, কলাতলীসহ সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা যায় পর্যটকের ঢল নেমেছে। নানান বয়সের দর্শনার্থীরা বালুচরে উৎসবের আমেজ আর ঢেউয়ের তালে সুন্দর মুহূর্ত উপভোগ করছেন।
সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, সাগর তুলনামূলক শান্ত থাকায় পর্যটকদের বাড়তি উৎসাহ রয়েছে সমুদ্রস্নানে। বালুচরে বিচ বাইক, ঘোড়ায় চড়া, জেড স্কীতে সমুদ্র ভ্রমণ, সব মিলিয়ে জমজমাট দৃশ্য। শিশুরা ভেজা মাটি দিয়ে তৈরি করছেন খেলনার প্রাসাদ। বড়রা খুঁজে নিচ্ছেন ক্লান্তি দূর করার প্রশান্তি।
নরসিংদী থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক আবেদ খান বলেন, “বালিয়াড়িতে বসে সমুদ্র দেখা—এটাই যেন কক্সবাজারের আসল উপভোগ। এই দৃশ্য মনকে অন্যরকম প্রশান্তি দেয়।”
কুমিল্লা থেকে আসা নাসরিন আঞ্জুম বলেন, “ভাগিনার সাথে আকাশে রঙ্গিন ঘুড়ি উড়ালাম। তার আনন্দের সঙ্গে আমিও শৈশবে ফিরে গেলাম।”
রাজশাহী থেকে আসা পর্যটক আজিজুল হক জানান, “সমুদ্র সবসময়ই টানে। সুযোগ পেলেই কক্সবাজারে ছুটে আসি। এবারও বন্ধুরা মিলে এসেছি, খুব উপভোগ করছি।”
মৌসুমের শুরুতেই পর্যটকের ভিড় বাড়ায় সৈকতপাড়ের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।
জেড স্কী চালক হাসান বলেন, “শীতের শুরুতে পর্যটক আসছে কক্সবাজারে। ব্যবসা এখন বেশ ভালো যাচ্ছে। সামনে আরও বাড়বে বলে আশা করছি।”
ঝিনুক ব্যবসায়ী হাফিজুল করিম বলেন, “দিন দিন ঝিনুকের চাহিদা কমে যাচ্ছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি ঝিনুক দিয়ে নানান ধরনের জিনিসপত্র, অলংকার তৈরি করে পর্যটকদের মাঝে আকর্ষণ বাড়াতে। শীতের শুরুতেই পর্যটকের ভিড় বাড়ায় আমরা বেশ আশাবাদী।”
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল-গেস্টহাউস অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ কলিম বলেন, “শীতের শুরুতেই পর্যটকের চাপ বাড়তে শুরু করেছে। পর্যটকের আগমনে কক্সবাজারের পর্যটন খাতে নতুন প্রাণ ফিরবে বলে আশা করছি । হোটেল-মোটেল ও গেস্টহাউসগুলোতে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও পর্যটকবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করছি। পর্যটকের সন্তুষ্টিই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।”
এদিকে পর্যটকদের নিরাপত্তায় সৈকতের তিনটি পয়েন্টে ২৭ জন লাইফগার্ড, ৩৮ জন বিচকর্মী এবং অর্ধশত স্বেচ্ছাসেবী সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন।
বিচকর্মীদের সহকারী সুপারভাইজার মো. বেলাল হোসেন বলেন, “কক্সবাজারে বেড়াতে আসা প্রতিটি পর্যটকের নিরাপত্তাকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই। প্রতিটি পর্যটন স্পর্ট সার্বক্ষণিক আমাদের নজরদারিতে থাকে। কোনো পর্যটক বিপদে পড়লে দ্রুত সহায়তা দেওয়াই আমাদের প্রথম দায়িত্ব। সবাইকে অনুরোধ করছি নির্ধারিত নিরাপদ সীমার মধ্যে থেকে ও নির্দেশনা মেনে চললে নিরাপদে এবং আনন্দে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত উপভোগ করা সম্ভব।”
সি সেইফ লাইফগার্ড’ প্রকল্পের ফিল্ড টিম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “পর্যটক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তৎপরতা আরও জোরদার করা হয়েছে। নিয়মিত মাইকিং করে সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, পানিতে নামা পর্যটকদের প্রতিটি পদক্ষেপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে যাতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।”
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের প্রধান, অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, “সমুদ্রসৈকতে আগত প্রতিটি পর্যটকই আমাদের অতিথি। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ট্যুরিস্ট পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সৈকতের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমাদের টহল ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।”
কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন নৌরুটে ১ নভেম্বর থেকে জাহাজ চলাচলের অনুমতি থাকলেও রাত্রিযাপনের অনুমতি না থাকায় গত ১৪ দিনে কোনো পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করেনি।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, “সেন্টমার্টিন কক্সবাজার শহর থেকে দূরে হওয়ায় আসা-যাওয়া করতে পুরো দিন লেগে যায়। তাই রাত্রিযাপন ছাড়া পর্যটক আসেন না, আর আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছি। দ্বীপের অর্থনীতি প্রায় অচল; হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্রলার, দোকান সবকিছুই বন্ধের পথে। পুরো দ্বীপের জীবিকা পর্যটননির্ভর হওয়ায় মানুষ অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। পরিবেশ রক্ষা জরুরি, তবে স্থানীয়দের জীবিকার বিষয়টিও সরকার যেন গুরুত্ব দিয়ে দেখে এটাই আমাদের অনুরোধ।”












