বৃষ্টি নামলেই আতঙ্ক, আগাম সংকেতের পরেও থামছে না পাহাড়ধসে মৃত্যু! করণীয় কী?

কক্সবাজার

তারেকুর রহমান, কক্সবাজার ||

রাতভর টানা বৃষ্টি। পাহাড়ের বুক থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে কাদা-পানির স্রোত। হঠাৎ গর্জে ওঠে মাটি, চোখের পলকে চাপা পড়ে ঘরবাড়ি ও তাজা প্রাণ। এমন মর্মান্তিক দৃশ্য কক্সবাজারে এখন প্রায় নিত্যঘটনা। সময়-অসময়ে প্রবল বর্ষণেই নেমে আসে পাহাড়ধসের ভয়াল দুর্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই বিপর্যয় কি আগেই জানা সম্ভব নয়? কতটা বৃষ্টি হলে ধস নামে? কেনো পাহাড় হারাচ্ছে ভারসাম্য? মাটির গঠন, বন উজাড়, নাকি মানুষের বসতিই এর দায়ী?

তথ্য অনুযায়ী, শুধু কক্সবাজার শহরেই পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ। ৫০ থেকে ৭০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে দেদারসে ঘরবাড়ি নির্মাণ চলছে এখনো। শহরের ঘোনারপাড়া, পাহাড়তলী, লারপাড়া, কলাতলী, চন্দ্রিমা হাউজিং, সাহিত্যিকাপল্লীসহ শহরের ২০ থেকে ২৫টি এলাকায় এমন অনিরাপদ বসতি গড়ে উঠেছে।

স্থানীয়রা জানান, পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণের ফলে সৃষ্ট মাটি বৃষ্টির পানির সঙ্গে নেমে পৌরসভার নালা-নর্দমা ভরাট করছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।

এদিকে গত এক দশকে কক্সবাজার জেলায় ২১টি পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৮ জন। এর মধ্যে ২৯ জন স্থানীয় বাসিন্দা এবং ১৯ জন আশ্রিত রোহিঙ্গা। প্রশাসনিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব ঘটনার মধ্যে ১০টি পাহাড়ধস ঘটেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায়। এছাড়া, এসব দুর্ঘটনায় অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন আহত হয়েছেন।

পাহাড় ধসের আগাম বার্তা কতক্ষণ আগে জানা যায়:

কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুল হান্নান জানান, “যখন টানা সাতদিন ধরে অল্প অল্প বৃষ্টি হয় বা কোনো একদিনে ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা যায়, তখন পাহাড়ের মাটি ধীরে ধীরে নরম হয়ে ধসের ঝুঁকি তৈরি হয়।”

তিনি বলেন “আমরা টানা ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করলেই পাহাড়ধসের সম্ভাবনার বিষয়ে সতর্কবার্তা দিই। এই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হতে সাধারণত ৬ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত অবিরাম বৃষ্টি লাগে।”

আবহাওয়াবিদ আব্দুল হান্নানের মতে, এই প্রক্রিয়ায় মূলত বৃষ্টিপাতের পরিমাণই পাহাড়ধসের পূর্বাভাস নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলে তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসন, তথ্য অফিস, সিপিপি এবং স্থানীয় এনজিওগুলোর মাধ্যমে জনগণের কাছে সতর্কতা পৌঁছে দেওয়া হয়, যাতে সময়মতো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। যদিও এবিষয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া ও সরে যাওয়ার গতি কম।”

এভাবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, তথ্য আদান-প্রদান ও সমন্বিত সতর্কতা ব্যবস্থার মাধ্যমেই পাহাড়ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব বলে মনে করেন এই আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ।

প্রতিবছর বর্ষা এলেই পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, তবু ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরানো যায় না। সারাবছর প্রশাসন নীরব থাকে, কিন্তু টানা বর্ষণ শুরু হলেই শুরু হয় তৎপরতা ও হাঁকডাক। তবুও অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান ছাড়তে রাজি হন না। এর ফলেই প্রতি বছর পাহাড়ধসে ঝরে যায় মানুষের প্রাণ। এ নিয়ে বনবিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর বহু মামলা করলেও পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন ঘটেনি।

ঘোনারপাড়ার বাসিন্দা মোসলেম উদ্দিন (৪৭) বলেন, “আমরা জানি, পাহাড়ে থাকা বিপদজনক। অতিবৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের আশঙ্কায় অনেকে নিরাপদ আশ্রয়। আবার অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে ঘর ছেড়ে যায় না। কারণ থাকার আর কোনো জায়গা নেই। সরকার যদি আমাদের সমতলে বসবাসের জায়গা দেয় তবে আমাদের আর পাহাড় থাকতে হবে না।”

পাহাড়তলী এলাকার গৃহবধূ নুরজাহান বেগম (৩৬) বলেন, “বৃষ্টিতে মাটি নরম হলে ভয় লাগে। গত বছর পাশের ঘর ধসে পড়েছিল। আমরা এখন আর পাহাড়ে থাকতে চাই না। আমাদেরকে পুনর্বাসন করলে আমরা চলে যাবো”

লারপাড়ার রিকশাচালক মোহাম্মদ হারুনর রশিদ (৩২) বলেন, “প্রতিবার প্রশাসন আসে, মাইকিং করে। মাইকিং করলে পাহাড় ধসের পূর্বাভাস পাই। কিন্তু সরে গেলে থাকবো কোথায়? আমরা নিরাপদে থাকার জন্য জায়গা চাই, যাতে বাচ্চাদের নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারি।”

খাজা মঞ্জিল এলাকার বাসিন্দা আফসার উদ্দিন বলেন, “দুই যুগ আগে থেকেই আমরা পাহাড়ে বসবাস করছি। বৃষ্টি হলে সতর্ক থাকি, পাহাড় থেকে দূরে থাকি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এখন বুঝতে পারি কী পরিমাণ বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গায়ে ফাটল ধরবে। এসব বিষয়ে আমরা সচেতন থাকার চেষ্টা করি।”

কেন পাহাড় ধসে পড়ে:

অবিরাম ও ভারী বৃষ্টিপাত হলে মাটির নিচের স্তর পানিতে ভিজে আঠালো হয়ে যায়, ফলে মাটি নিজের ওজন সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মারুফ হোসেন।

তিনি জানান, অতিবৃষ্টি ছাড়াও মানুষের অযাচিত পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ের প্রাকৃতিক ঢাল ও ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। গাছের শিকড় মাটিকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে রাখে; কিন্তু গাছ কেটে ফেললে সেই বন্ধন ভেঙে যায়। ফলে বৃষ্টির পানি সরাসরি মাটির স্তর ধুয়ে নেয়, মাটি আলগা হয়ে পড়ে। শুকনো অবস্থায় তা শক্ত মনে হলেও ভেতরে ফাঁপা থেকে যায়। একটানা বৃষ্টির সময় এই আলগা মাটির বন্ধন ভেঙে পড়েই পাহাড়ধসের সৃষ্টি হয় এটাই প্রধান ভূতাত্ত্বিক কারণ।

মারুফ হোসেন বলেন, “কক্সবাজারের পাহাড়গুলো মূলত বালি, দোআঁশ ও সিল্টযুক্ত মাটির গঠিত, যা আর্দ্রতা পেলে দ্রুত ভেঙে পড়ে। এসব মাটি কাদামাটির মতো শক্ত নয়, তাই বৃষ্টিতে সহজেই ধসে যায়। এর সঙ্গে পাহাড়ের ওপর ও পাদদেশে বসবাসকারী হাজারো পরিবারের ঘরবাড়ি, বজর্য এবং অপরিকল্পিত স্থাপনা পাহাড়ের মাটিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। এতে পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ঝড়-বৃষ্টির সময় প্রায়ই ধসের ঘটনা ঘটছে।”

গাছ মাটিকে কীভাবে ধরে রাখে :

বনকর্মকর্তা মারুফ হোসেনের মতে, গাছের শিকড় নিচের মাটিকে জালের মতো আঁকড়ে রাখে। শিকড় যত গভীর, মাটির বন্ধন তত শক্ত। বিশেষ করে বট, বেল, আম, তেঁতুল, শিমুল, মহুয়া প্রজাতির গাছ এবং বঁাশ, বেত ও ঝাউবন পাহাড়ের মাটিকে সবচেয়ে ভালোভাবে ধরে রাখে।

গাছ কমছে কেন :

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দিপু বলেন, “বনভূমি ধ্বংসের কারণেই পাহাড়ে আর প্রাকৃতিক শিকড়ের বাঁধন নেই। বন উজাড়ের হার বেড়েছে পর্যটননির্ভর নির্মাণ, কাঠ সংগ্রহ ও বস্তিবাসীদের জ্বালানি নির্ভরতার কারণে।”

এই পরিবেশবিদের মতে, পাহাড়ি গাছ কমার কারণগুলো হলো- পাহাড় কেটে ইটভাটা ও হোটেল নির্মাণ, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে বন নিধন, বস্তিবাসীদের রান্নার জন্য গাছ কাটা, কৃষি জমি তৈরির জন্য বনভূমি দখল এবং সঠিকভাবে পুনরায় বনায়ন না হওয়া।

গাছ বাড়াতে করণীয় :

গভীরমূল গাছের চারা রোপণ করতে হবে। পাহাড়ের ঢালে বাঁধ তৈরি ও টেরাসিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও যুব সংগঠনকে বৃক্ষরোপন অভিযানে যুক্ত করা যেতে পারে। বনবিভাগকে পাহাড়ি গাছ কাটার মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষমতা দিতে হবে বলে মনে করেন কক্সবাজারের পরিবেশবিদ দীপক শর্মা দিপু।

মানুষ কী করতে পারে:

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, “প্রতিবার পাহাড় ধসের পর আমরা দৌঁড়ঝাপ দেখি, কিন্তু আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা খুব কম। মানুষকে বুঝতে হবে, পাহাড়ে বসবাস মানে মৃত্যুর সঙ্গে সহবাস। এখনই সরকার ও নাগরিক উভয়কে দায়িত্ববান ও সচেতন হতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারী মানুষদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় পাহাড়ের ঢাল থেকে দূরে থাকা এবং পাহাড়ের গায়ে ফাটল বা দেয়াল হেলে পড়ার মতো লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। এজন্য প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় স্থানীয় সতর্কবার্তা টাওয়ার, রেইন গেজ মেশিন ও ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড বসানো গেলে সাধারণ মানুষ সময়মতো বুঝতে পারবে কখন পাহাড় ছাড়তে হবে।”

প্রশাসনের পর্যবেক্ষণ :

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম বলেন, “পুনর্বাসনের জন্য স্থায়ী জায়গা না থাকায় পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরানো কঠিন হয়। তবে আমরা প্রতি বর্ষায় মাইকিং, আশ্রয়কেন্দ্র খোলা ও যৌথ অভিযান চালাই। এ বিষয়ে প্রশাসন সবসময় সতর্ক অবস্থানে থাকে।”

সচেতন মহল মনে করছেন, পাহাড়ধস রোধে পরিকল্পিত শহর, কঠোর আইন প্রয়োগ, বিকল্প আবাসন, ব্যাপক বৃক্ষরোপণ এবং নাগরিক সচেতনতা এখনই প্রয়োজন। এ ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।
একসময় সৌন্দর্যের প্রতীক ছিল কক্সবাজারের পাহাড়, কিন্তু এখন তা অব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি। সময় থাকতেই পাহাড়কে রক্ষা করতে হবে, কারণ পাহাড় বাঁচলেই বাঁচবে মানুষ ও প্রকৃতি।