তারেকুর রহমান, কক্সবাজার ||
টেকনাফ উপজেলায় অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও প্রবল বাতাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক’শ পানের বরজ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এ থাবায় পানচাষীরা পড়েছেন আর্থিক সংকটে।
টেকনাফের মাথাভাঙ্গা এলাকার পানচাষি মোস্তাফিজুর রহমান বলছিলেন “২ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করে পানের বরজ করেছিলাম, কিন্তু দমকা হাওয়া আর অতিবৃষ্টিতে সব হেলে পড়েছে, পানি জমে গাছ পচে গেছে”। তার ১০ শতাংশ জমির ওপর চাষ করা মিষ্টি পানের বরজে এখন কেবল ভাঙা কঞ্চি আর নুয়ে পড়া গাছ।
সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলীয় এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ওই অঞ্চলে মিষ্টি ও গাছ পান এই দুই ধরনের পান চাষ হয়। উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গা, হাজামপাড়া ও মারিশবুনিয়া এলাকায় রয়েছে প্রায় দুই হাজার পানের বরজ। অতিবৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় একের পর এক পানের বরজ হেলে পড়েছে, জমে থাকা পানিতে গাছ পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় কৃষক নূর মোহাম্মদ বলেন, “এবার বরজের চাষ আগাম বসাতে পারিনি। তাই অতিবৃষ্টির কারণে সময়মতো পানগাছ লাগাতে না পারায় ফলনও প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েছে। আগাম চাষ করতে না পারাই দামও অনেক কম পাই। যে খরচ ও শ্রমে চাষ করেছি, তা কোনোভাবেই পোষাচ্ছে না। খরচ মেটাতে গিয়ে ঋণের বোঝা বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী মৌসুমে চাষ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না”। এতে চাষিদের মুখে ভেসে উঠছে উদ্বেগের চিহ্ন ও হতাশা, তবে কেউ কেউ বিকল্প উপায়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করছেন।
স্থানীয় কৃষক মোহাম্মদ ফারুক বলেন, “বরজের চারপাশে দড়ি দিয়ে শক্ত বেষ্টনী তৈরি করলে প্রবল বাতাসের ধাক্কা সামলানো যায়। সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকলে অতিবৃষ্টির পানি জমে থাকে না, আর গোড়ায় পলিথিন বিছিয়ে দিলে সহজেই পানি সরিয়ে দেওয়া সম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, “এখন তো আবহাওয়া অনিয়মিত। কখনো অসময়ে বৃষ্টি, কখনো আবার জোয়ারের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে। তাই আবহাওয়ার খবর জেনে পরিকল্পনা করে চাষ করাই একমাত্র উপায়। আমি সেই পথই বেছে নিয়েছি, আর সেইভাবেই পান চাষ চালিয়ে যাচ্ছি।”
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবহার, বরজের ড্রেনেজ উন্নয়ন, গোড়ায় পলিথিন দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ এবং দমকা হাওয়ায় বেষ্টনী তৈরির মতো উদ্যোগই জলবায়ু সহনশীল চাষে সহায়ক হতে পারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় পান চাষের জমির পরিমাণ ২ হাজার ৮৫৫ হেক্টর। তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি মহেশখালী উপজেলায় ১ হাজার ৬০০ হেক্টর, টেকনাফ উপজেলায় ৫৭০ হেক্টর। এছাড়াও রামুতে ২০০ হেক্টর, চকরিয়ায় ৫০ হেক্টর, পেকুয়ায় ২০ হেক্টর, সদর উপজেলায় ৮৫ হেক্টর এবং উখিয়ায় ৩০ হেক্টর।
টেকনাফ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, “এ মৌসুমে অতিবৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় অধিকাংশ বরজ আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন বছর আগে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে উপজেলার ৩০ জন চাষিকে বরাদ্দ প্রদান ও আবহাওয়াভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পান চাষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে বরাদ্দ সংকটের কারণে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম কিছুটা কমে গেছে। তবুও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নিয়োজিত কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত পান চাষিদের দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।”
কক্সবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. বিমল কুমার প্রমাণিক বলেন, “এক বছরে বিভিন্ন দুর্যোগে কক্সবাজার জেলায় প্রায় ৫ হেক্টর পান বরজ নষ্ট হয়েছে। কিছু এলাকায় প্রবল বাতাস ও লবণাক্ত পানি প্রবেশের কারণে পান গাছের ক্ষতি এখনও চলছে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব। মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের ধরন বদলে যাওয়ায় টেকসই পান চাষের জন্য কৃষকদের দ্রুত পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন পদ্ধতি ও পরিকল্পনা নিয়ে চাষাবাদ করতে হবে।”