ভ্রমণ- কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
রফিক উল্লাহ্ :
ডিজিটাল পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাত্রা প্রায় রোবটের মত। একটি নির্দিষ্ট স্থানে সারাটি বছর যেমন বাসা, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সারাক্ষণ বসে থাকতে থাকতে জীবনের গতি থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। ছোট্ট একটি অফিস, চেয়ার-টেবিল, কেবিনেট ও আলমারি, একই রকম দেয়াল, কম্পিউটার, চায়ের কাপ-পিরিচ ও টুং টাং শব্দ, দেয়াল ঘড়ি, মোবাইল ফোন ও রঙ বেরঙয়ের মিউজিক, টেলিফোন অপারেটর ও তার কন্ঠ এবং আব্দুল সবইতো একই। আব্দুলের প্রতিদিনের এক ধরণের জামা, আবার সে জামা সপ্তাহ খানেক না ধোয়ার কারণে অনেক ময়লা ও একটি অস্বাভাবিক দুর্গন্ধ লেগে আছে সারাক্ষণ। ডাক দিলে জি স্যার, আসি স্যার আর কত শোনতে ভাল লাগে। মাঝে মধ্যে নাক ছিটকানো কারণে অকারণে। টেলিফোন অপারেটর যখন তখন বলে স্যার আপনার ফোন। সে সকাল থেকে অফিস শেষ অবধি। মাঝে মধ্যে নিজেকে অস্থির মনে হয়। মন চায় যে, চার দেয়ালের বেষ্টনি ভেঙ্গে মৌসুমি পাখির মতো অজানা অদূরে কোথাও চলে যেতে। অস্থির অশান্ত মনকে এবং জীবনের গতিকে বেগবান ও মনে সামান্য উষ্ণতা আনার জন্য এবং মনকে সামান্য আনন্দ দেয়ার জন্য অন্তত বছরে একবার, পারলে তারও বেশি সে চিহ্নিত স্থানটি পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তখন মানুষের মন চায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াতে, মোবাইলটি বন্ধ করে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকতে। মন চাইলে কী হয়? যদি না হয়? হওয়া প্রয়োজন। মনের সাধ মিঠাতে হলে প্রয়োজন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা একটি সুন্দর স্থান, যাতে রয়েছে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাখির কল-কাকলি, সমুদ্রের গর্জন, পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য, মধ্যরাতে বন্ধুদের আড্ডায় নীল আকাশে জোসনা দেখা, আকাশে ঝকঝকে তারার মেলা সবই যদি একসাথে পাওয়া যায়। সাথে প্রয়োজন ভ্রমণে যাওয়ার উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপত্তাসহ বিবিধ নাগরিক সুবিধাসমুহ। এসব সুবিধাসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে হলে বাংলাদেশের একমাত্র মনোমুগ্ধকর স্থান ককস্বাজার জেলাকে সর্বাগ্রে বেছে নিতে হবে। বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত যা ককস্বাজার থেকে টেকনাফের সর্বশেষ সাবরাং গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। সাবরাং এর নাফ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তাকালে অপরূপ সৌন্দর্য নাফ নদীসহ মায়ানমার ভ্রমণেরও আংশিক সাধ পূরণ হয়। তারপর সাগর কন্যা সেন্টমার্টিন। যে জেলাকে পর্যটকদের জন্য যৌবনে ভরা বিশ্বের সেরা সুন্দরী রমণী বলা যেতে পারে। যেখানে বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকগণ একবার ভ্রমণ করলে বার বার আসতে চান।
ককস্বাজার জেলার সকল স্থান এত বেশি সুন্দর ও আকর্ষণীয় যে একবার দেখলে বারবার আসতে চায় মন। তারপর আরও আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন স্থান ঐতিহাসিক কুদুম গুহা। যা না দেখলে ককস্বাজার জেলা ভ্রমণের পূর্ণতা আসে না। গুহাটি আবিষ্কারের পর থেকে কাছের মানুষও বার বার দেখতে যায়। সে কুদুম গুহা নিয়ে অনেক রূপকথা ও গল্প প্রচলিত আছে।
কুদুম গুহা সম্পর্কে প্রচলিত উপকথা
কুদুম শব্দের অর্থ লম্বা গুহা। কুদুম শব্দটি চাকমা ভাষা থেকে এসেছে। আদিকাল হতে এটি চাকমা অধ্যুষিত অঞ্চল। বহুকাল পূর্বে কুদুম গুহায় এক অপরূপা সুন্দরী পরী বাস করতো। গুহার ভেতরে ছিল সোনালী ধান ও ফসলের ক্ষেত, আর ছিল বিস্তৃত সবুজ মাঠের চারণ ভূমি। গুহার মুখে বসে সোনার সুতা দিয়ে কাপড় বুনতো পরী। পাশে ছিল চমৎকার এক বন। রোজ সেখানে গরু চরাতে আসতো এক রাখাল। একসময় রাখাল ছেলের সাথে ঐ পরীর বন্ধুত্ব হয়। পরী রাখালকে প্রতিদিন গুহার ভেতর নিয়ে যেত। নানা ধরণের সুস্বাদু খাবার খেতে দিত। রাখালের গরুগুলোর জন্য পরী ঘাসের যোগান দিত। পরীর এসব গোপন কথা যেন প্রকাশ না করে, রাখালকে প্রতিজ্ঞা করালো। পাশ্ববর্তী আরকান রাজ্যের এক যাদুকর ইন্দ্রজালের মাধ্যমে জেনে ফেলল পরীর এসব গোপন কথা। পরীর দুটো চোখ ছিল খুবই মূল্যবান। চোখ দুটি নিতে পারলে সে জাদুকর অমরত্ব লাভ করতে পারবে। যাদুকর রাখালের গ্রামে এসে হাজির হল। রাখালকে জাদুকর নানাভাবে লোভ দেখিয়ে পরীর গোপন রহস্য জেনে নিল। গোহার ভেতর সমস্ত ধন রত্নের লোভ দেখিয়ে জাদুকর রাখালকে বশ করলো। মন্ত্র পড়া এক গ্লাস পানি হাতে দিয়ে বললো, পরীর গায়ে ছিটিয়ে দিতে। কথা মতে রাখাল মন্ত্র পড়া পানি পরীর গায়ে ছিটিয়ে দিল। মন্ত্র পড়া পানি ছিটানোর পর পরীর রূপ বদলে গেল। অপরূপ সুন্দরী পরী ভয়ংকর বাঘের রূপ ধারণ করল। মন্ত্র পড়া পানি পরীকে পাথরের মুর্তিতে রূপান্তরিত করল। জাদুকর পরবর্তীতে তার কথা রাখেনি। রাখালকেও সে জাদুকর মেরে ফেলল। গুহার ভেতরের বিস্ময়কর প্রকৃতিও ধ্বংস করে ছিল। কথিত আছে, কুদুম গুহার দিকে একা গেলে কখনো কখনো সে বিস্ময়কর পরীর মুর্তি দেখা যায়। গুহাটি আবিস্কারের পর হতে এলাকাটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে দূরের ও কাছের মানুষের কাছে সমাদর লাভ করেছে।
কুদুম গুহার বর্ণনা :
কুদুম গুহাটি পূর্বমুখী। পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বিভাবে পাহাড়ের ভেতর অবস্থিত। গুহার সম্মুখে একটি পাহাড়ি ছরা আছে যা দিয়ে সবসময় পানি প্রবাহিত হয়। গুহাটি অনেক লম্বা, প্রবেশ মুখ প্রায় ২ মিটারেরও বেশি চওড়া এবং একেবারে উপরের দিকে ১৫ মিটারের কাছাকাছি। গুহার ভেতরে কোথাও সংকুচিত আবার কোথাও বিস্তৃত পরিসর আছে। সবচেয়ে বড় পরিসরটি হচ্ছে ২.৫ মিটার। এর উচ্চতা বিভিন্ন স্থানে ১০ হতে ১৪ মিটার। এর ছাদ উত্তল এবং দেয়াল সে তুলনায় অবতল। গুহার শেষ প্রান্ত ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে ভূমির সাথে মিশে গেছে। এই অপ্রশস্ত শেষ প্রান্তটি হতে সব সময় পানি ঝরছে। অবশিষ্ট অংশে সব সময় পানি পড়তে দেখা যায় না। গুহার তলদেশ হতে অল্প অল্প পানি প্রবাহ দেখা যায়। গুহার তলদেশে সারা বছর ৩০ সেঃ মিঃ হতে ৬০ সেঃ মিঃ পর্যন্ত পানি থাকে। বর্ষাকালে পানি বেড়ে প্রায় এক মিটার পর্যন্ত হয়। পানি সব সময় ঠান্ডা অনুভূত হয়। গুহার প্রবেশ মুখটি ৪-৫ মিটার উঁচু। সে কারণে সূর্যের আলো গুহার ছাদ বা কয়েক মিটারের বেশি ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। গুহার শেষ ৩ মিটার এলাকা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কথিত আছে, টর্চের আলো গুহার ভেতরে যায় না। গুহার সম্মুখভাগে এবং আশপাশের এলাকাতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বিশেষ করে মৌটুসী, কাঠ ঠোকরা, বুলবুলি, ফিঙ্গে, ধনেস, ময়না, রঙ বেরঙয়ের টিয়ে, মাকড়শাভূক এবং টুনটুনি পাখি দেখা যায়। স্তন্যপায়ী প্রাণির মধ্যে কাঠবিড়ালী সহজেই দেখা যায়। রেসাস বানর এবং মুখপোড়া হনুমান মাঝে মধ্যে দেখা যায়। পাঁয়ের ছাপ দেখে বোঝা যায় শিয়াল, বেঁজি, বন্য শুকর, হাতি এবং মায়া হরিণও এখানে আসে।
যে প্রাণি কুদুম গুহাকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করেছে সেটি হল বাদুড়। চাকমা ভাষায় কুদুম অর্থ লম্বা গুহা। এটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি গুহা যার তলদেশে সবসময় পানি থাকে। বাদুড় আবাসস্থল হিসেবে এই গুহা ব্যবহার করে। অনেক সময় প্রায় ৫০০ মিটার দূর হতেও বাদুড়ের শব্দ শোনা যায় এবং বায়ু প্রবাহের দিকের উপর নির্ভর করে ২০০ থেকে ৫০০ মিটার দূর থেকে বাদুড় ও বাদুড়ের পায়খানার গন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় গ্রামবাসীদের তথ্য মতে, শত শত বছর ধরে এই গুহাতে বাদুড় বসবাস করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, গুহার ভেতরে বাদুড়ের কোন পায়খানা দেখা যায় না। তথ্য-নিসর্গ হতে। ভ্রমণের প্রস্তুতি
ভ্রমণে আনন্দ, ভ্রমণে শান্তি, আবার ভ্রমণে ক্লান্তিও থাকে। অনেক সময় ভ্রমণে অশান্তিও নেমে আসে। তাই ভ্রমণে বের হতে হলে আনন্দ যেন বেদনায় রূপান্তরিত না হয় সে দিক বিবেচনা করে বের হওয়া প্রয়োজন। ভ্রমণের কয়েক দিন পূর্ব হতে একটি ছোট কাগজে সব কিছু নোট করে রাখলে ভাল হয়। সেটিকে চেকলিস্ট বলা যেতে পারে। কোন স্থানে কত সময় ব্যয় হতে পারে, কতটি জায়গায় ঘুরে বেড়ানো যাবে, ব্যবহারের জন্য কি কি মালামাল নিতে হবে, কতটি ব্যাগ হবে, কোন ব্যাগে কি কি থাকবে এসব পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে গোছালোভাবে ভ্রমণ করা যায়। ভ্রমণে যাওয়ার সময় তড়িঘড়ি করে বের হলে অনেক সময় প্রয়োজনীয় জিনিস বাদ পড়ে যায়। ছোটখাট অতি প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে না নেয়ার কারণে ভ্রমণ সুখকর হয় না। তা নিয়ে সারা পথ কষ্ট পেতে হয়, নিজেরও মন খারাপ হয়ে যায় অনেক সময়। ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরার সময় উক্ত তালিকা দেখে সকল জিনিসপত্র গুছিয়ে আনা সম্ভব হয়। অন্যথায় অনেক, অতি প্রয়োজনীয় মূল্যবান সামগ্রী মনের অজান্তে রয়ে যায়। যার জন্য ভ্রমণে বের হওয়ার পূর্বে যেখানে টুরিস্ট গাইড পাওয়া যায় একটু চোখ বুলিয়ে নিলে ভাল হয়। প্রস্তুতি নেয়ার সময় বিশেষ করে, ক্যামেরা, শুকনো খাবার, পানীয় জল, ছোট ছেলে-মেয়ে থাকলে তাদের খাবারসহ শীতকালে গরম কাপড়, বমির জন্য পলি ব্যাগ, বৃষ্টির সময় ছোট একটি ছাতা ব্যাগে নেওয়া বাঞ্চনীয়। নিজের গাড়িতে করে রওয়ানা করলে কম বয়সের ছেলে-মেয়েরা গাড়িতে গানের তালেতালে গাড়ির চালককে জোরে গাড়ি চালাতে বলে। গাড়িতে কোন বয়স্ক লোক থাকলে তা করা হতে বিরত থাকতে বলতে হবে। কারণ গাড়ি চালক মালিকের পক্ষ হতে উৎসাহ পেলে তার গতিসীমা হারিয়ে ফেলে, তখন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে। গাড়ির গতি সবসময় আয়ত্বের মধ্যে রাখতে হবে। চালকের একটু ভুলের কারণে ভ্রমণের সমস্ত আনন্দ নষ্ট হতে পারে। ছেলে মেয়েরা বন্ধুদের সাথে বের হয়ে যদি দূরে কোথাও যায় তাহলে সাথে একজন অভিভাবক থাকলে ভাল হয়। অন্যথায় কিছু সময় পর পর ফোন করে তাদের খবরা খবর নিতে হবে। এমনও অনেক নজির আছে পরিবারের একমাত্র ছেলে বেড়াতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছে, যা ঐ পরিবার সারা জীবন কষ্ট পেতে হচ্ছে। ভাড়া গাড়িতে করে বের হলে গাড়ি চালক যদি দ্রুত গাড়ি চালায়, চলন্ত অবস্থায় মোবাইলে কথা বলে বা অন্য মনস্ক থাকে তা হলে চালককে কৌশলে সাবধান করতে হবে। অনেক দূরের গন্তব্যে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে সব কিছু যদি ঠিক থাকে তা হলে ভ্রমণে আনন্দ আসবে এবং ভ্রমণ শেষে পুনরায় স্ব-স্ব স্থানে সঠিকভাবে পৌছানো সম্ভব হবে, ভ্রমণ সফল হবে। পরবর্তী সময়ও ভ্রমণে যাওয়ার উৎসাহ যোগাবে।
ভ্রমণে কক্সবাজার :
কক্সবাজার জেলার প্রবেশদ্বার আপনাকে স্বাগত জানাবে সবুজের সমাহার, দুধারে বনের অপরূপ সৌন্দর্য চকরিয়া থানার সর্ব উত্তর প্রান্তে আরাকান সড়কে দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক স্থপতিদের কারুকার্যে সৌন্দর্যমন্ডিত কক্সবাজার গেইট। গেইট দেখে ধারণা পাওয়া যাবে এই বুঝি কক্সবাজার চলে এলাম। কক্সবাজার ভ্রমণের সাধ আরম্ভ হতে না হতেই পেয়ে যাবেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা অভয়ারণ্য দুলহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক। যাতে আছে বনের সবটুকু অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পার্কে বন্য প্রাণির মধ্যে বাঘ, হরিণ, হাতি, বিভিন্ন প্রজাতির বানর, কুমির, জলহস্তি, ভাল্লুক, সিংহ, জিরাফসহ নানা ধরণের পশুর বিচরণ, যা দেখলে ভ্রমণ পিপাসুদের মনে অনেক আনন্দ অনুভূত হবে। পাহাড়ের স্বচ্ছ পানিতে কানায় কানায় ভরপুর প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট অত্যাধুনিক আঁকাবাঁকা লেকটিতে ছোট ছোট নৌকাতে করে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানো যায়। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে হাতির পিঠে উঠা একটি বাড়তি আনন্দ যা সাফারি পার্কে সহজে উপভোগ করা যায়। সাফারি পার্ক ভ্রমণ শেষে ককস্বাজার জেলার রামু উপজেলার হাজার বছরের প্রাচীনতম বৌদ্ধ বিহার। নানা ধরণের কারুকার্য দিয়ে তৈরি অপরূপ সৌন্দর্য বৌদ্ধ বিহার, বর্ণিল রঙয়ে সাজানো হয়েছে। প্রায় কাছাকাছি অনেকগুলো বড় বড় মন্দির রয়েছে। যাতে আছে অতি প্রাচীনতম বৌদ্ধ মূর্তি ও ভগবান বুদ্ধের ছায়া মূর্তি। ভূবন শান্তি ১০০ ফুট সিংহ শয্যা গৌতম বুদ্ধ মুর্তি। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বৌদ্ধদের পবিত্র স্থান পরিদর্শনের ব্যাকুলতা আপনার মনকে বারবার আবেগে উদ্বেলিত করবে। সৈকত
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, যেখানে রয়েছে সিলিকনযুক্ত বালি, হাজারও প্রজাতির শামুক, ঝিনুক, ঔষধি গুল্ম লতা ও সাগরের তলদেশের কোরালসহ অসংখ্য মূল্যবান সম্পদ। সেসব মূল্যবান সম্পদ রক্ষা ও গবেষণার জন্য সরকারিভাবে ইনানিতে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট নির্মিত হয়েছে। নয়নাভিরাম সমুদ্রের ঢেউ, নীল জলের হাতছানি দেখে শুরু হবে মনের আলোড়ন। ককস্বাজারের বালুকাময় সৈকতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ হবে আপনার ভ্রমণের সাধ। লিংক রোড় হতে বাম দিকে উখিয়া ও টেকনাফ যাওয়ার সুবিশাল হাইওয়ে রোড়, ডান দিকে কক্সবাজার শহর ও সমুদ্র সৈকত। একটু এগুলে কক্সবাজার সরকারি কলেজ, নির্মাণাধীন কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ, পরে উপজেলা প্রশাসন। নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই পৌঁছে যাব কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। ককস্বাজার নামের নামকরণের পৃষ্ঠপোষক ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এর নামানুসারে ক্যাপ্টেন কক্স ফিলিং স্টেশন দেখলে মনে করতে হবে ককস্বাজার বাস স্টেশনে পৌঁছে গেছেন। বাস হতে নেমে যে কোন ছোট গাড়িতে সাগর পাড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা বা নিজের গাড়িতে করে রওয়ানা করলে মনের ভাবনা ও কল্পনা শুরু হতে না হতেই বঙ্গোপসাগরের গর্জন কানে পৌছানো শুরু হবে। চোখের পলকে দেখা যাবে ককস্বাজার টিভি সেন্টার। এই টাওয়ারের পাদদেশে পৌছা মাত্র সাগরের জল রাশি কখনো বিশাল আবার কখনো ছোট ছোট ঢেউ দু’চোখে দেখতে দেখতে মন ভরে যাবে। অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে কলাতলী মোড় হতে ডানে বা বায়ে যে কোন গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। যদি পূর্বে হতে হোটেল বুকিং থাকে তা হলে স্বাভাবিকভাবে কোন চিন্তা ছাড়াই হোটেলে পৌঁছে যাবেন। যদি বুকিং দেয়া না থাকে তাহলে ককস্বাজারের সাগর পাড়ের নানা বর্ণের, নানা ধরণের শৈল্পিক কারুকার্যে ভরা, আধুনিক স্থপতিদের মনের মত করে ডিজাইন করা সীমাহীন সৌন্দর্যের আবাসিক মোটেল ও হোটেলগুলো আপনাকে আতিথেয়তা প্রদানের জন্য হাতছানি দিচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে উত্তর দক্ষিণ লম্বা, পশ্চিম মুখী হোটেলে থাকলে অবসর সময়ে সাগরের গুনগুন্ শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে এবং বিশাল জলরাশি ও ছোট বড় ঢেউয়ের দৃশ্য আপনার কল্পনাকে বাস্তবের মাটিতে পৌঁছে দেবে। ককস্বাজার পৌছে হোটেল বা কটেজে উঠে হয়তো আপনি সামান্য বিশ্রাম নিতে গেলেই মন উতলা হয়ে ওঠবে। সমুদ্র সৈকতে কখন পৌছাবেন মন আনছান করে ওঠবে। পাগল মনের সঙ্গে সাড়া না দিয়ে পারবেন না। বিশ্রাম নিতে গিয়ে হয়তো ছটফট করবেন। ছুটে যাবেন সমুদ্র সৈকতে। শীতকালে শুকনো বালি চিক্ চিক্ করে, হাঁটার সময় যতই সামনে যেতে চায় মনে হবে ততই পিছনে যাচ্ছি। অনেক বিশাল সৈকতকে বড় মাঠের মত মনে হবে, যে দিকেই হাঁটবেন বা যে দিকেই দৌড়াবেন মনে হবে মাঠের শেষ নেই।
মানুষের সৃষ্ট ময়লা ব্যতীত প্রাকৃতিকভাবে কোন ময়লা নেই। শান্ত সাগরের পানি দেখতে সবুজ রঙের কখনো স্বচ্ছ সাদা বলে মনে হবে।
বর্ষাকাল ছাড়া সাধারণত পানি সবসমই স্বচ্ছ থাকে। ছোট ছোট ঢেউ, গুনগুন শব্দ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের সংগীতের সুরের মোছনা যেন সারাক্ষণ আপনার কানে অনুভূত হচ্ছে, যা অশান্ত মনকে শান্ত করার মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। বর্ষাকালে শুকনো বালি আর চোখে পড়ে না। কারণ সাগরের পানি বেড়ে যায়, তীর বা সৈকতের
বিস্তৃতি ছোট আকার ধারণ করে। বৃষ্টির কারণে শুকনো বালি ভিজে শক্ত
হওয়ায় হাঁটা ও চলাচলের জন্য অত্যন্ত আরামদায়ক। হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে যেন একটি সদ্য প্রস্তুত করা কার্পেটের উপর হাঁটছেন। উত্তাল সাগর, বজ্রের ডাকের মত কান ফাটানো গর্জন, বিশাল বিশাল ঢেউ একের পর এক মধ্য সাগর হতে সৃষ্টি হয়ে তীরে এসে আছড়ে পড়ছে যা দেখতে অবাক লাগে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে সামান্য শক্ত বালিতে হাঁটতে যে কত আনন্দ তা প্রকাশ করা যায় না। মন চায় অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে বেড়াই। কিন্তু সময়তো কম। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড রোদ, বাতাসে শুকনো বালি উড়িয়ে সকলের চোখে মুখে এবং জামার ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু সে বালিতে কোন ময়লা নেই, ভয়ের কোন কারণও নেই। সূর্য ও রৌদ্রস্নান যারা করে আনন্দ পায় তাঁদের জন্য বিনোদনের শেষ নেই। শ্বেত চামড়ার লোকদের প্রখর রোদে খোলা আকাশে শুকনো বালির উপর শুয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা মিষ্টি রোদে সূর্যস্নান করছেন। সারা বছরের যে কোন সময় দু’এক দিন বেছে নিয়ে ককস্বাজার ভ্রমণ করা যায় অতি সহজে। অবুঝ মনকে আনন্দ দেয়ার পরিকল্পনা করার চিন্তাও করা যায়। পূর্ণিমা রাতে সঙ্গিকে নিয়ে সৈকতের পাড়ে ঝকঝকে সাদা শুকনো বালির উপর বসে গল্প করতে করতে কখন যে বন্ধুর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ছেন তা কোনভাবেই অনুধাবন করা যাবে না, যতক্ষণ না আপনি পূর্ণিমার আলোতে সৈকতে বেড়াতে না যান। মনে হবে যেন সারা জীবনের সকল ক্লান্তি ও অশান্তি এক রাতেই দূর হয়ে যাবে। সৈকতে প্রবেশের পূর্বে পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃক প্রদত্ত নিয়ম কানুন ও বিধি বিধান অনুসরণ করা বাঞ্চণীয়। প্রচলিত বিধি না মানার ফলে অনেকে আনন্দের চেয়ে বেদনা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আপনার বেলায় সেরূপ কিছু না হোক, তাই কাম্য। সৈকতে গমনের পূর্বে ক্যামেরাটি সঙ্গে নেয়ার কথা ভুলবেন না। ছবি কথা বলে, ইচ্ছে মত ছবি তুলতে ভুলবেন না। বিশেষ করে সৈকতের স্মৃতি ক্যামরাবন্দি করতে আপনার সচেতনতা প্রয়োজন। সৈকতে আসার সময় যথা সম্ভব পরিমিত বা স্বল্প কাপড় পরিধান করে আসলে ভাল হয়। সৈকতের বালিতে খালি পায়ে হাঁটতে বেশি ভাল লাগে। স্যান্ডেল, জুতো ও অতিরিক্ত কাপড় না নেয়া শ্রেয়। বাড়তি কাপড় চোপড় আপনার সৈকতে বেড়োনোর আনন্দের অহেতুক ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে। সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে আপনার ইচ্ছে হবে সমুদ্রে গোসল করতে। তখন বাড়তি কাপড় চোপড়ের ঝামেলা আপনার জন্য খুবই কষ্টকর হবে। দু-এক দিন ককস্বাজারের সৈকতের বালিতে খালি পায়ে হাঁটলে শরীর ভালো থাকবে। বালির ছোট ছোট পাহাড় ও সমতল শুকনো বালিতে হাঁটতে পারলে বেশি আনন্দ পাওয়া যাবে, তবে পরিশ্রমও হবে। সৈকতের বালিতে কোন কাটা বা ধাতব পদার্থ থাকে না। অনেক্ষণ হাঁটা ও দৌড়ানোর পর ক্লান্তি আসলে মাঝে মাঝে মনে হবে হোটেলের দিকে যাই। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যে করা হয়নি ইতিমধ্যে। গ্রামে বেড়ে ওঠা কেউ পুকুরে কিংবা নদীতে বা খাল বিলে সাঁতার কেটে গোসল করেছেন। শহরে বেড়ে ওঠা কেউ সুইমিং পুলের বদ্ধ পানিতে গোসল করেছেন। হাতের কাছে বঙ্গোপসাগরের মত এত বড় সাগরের পানিতে গোসল করার সাধ অপূর্ণই থেকে যাবে। তাই শেষ ইচ্ছেটুকু পুরণ না হলে কক্সবাজার ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
সমুদ্রের পানিতে নামার পূর্বে খেয়াল রাখতে হবে তখন ভাটার সময় কি না। ভাঁটার সময় জানা না থাকলে নিকটস্থ টুরিস্ট গাইড বা সাগরের অভিজ্ঞতা আছে এমন কাউকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে পরেন। যদি ভাঁটার সময় হয় তাহলে কোন ভাবেই গোসলের জন্য সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। কারণ ভাঁটার সময় সাগরের পানি সবসময় সাগরের দিকে টেনে নেয়। যা খুবই বিপদজনক। চোরাবালির খপ্পরে পড়ে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে প্রচুর। তখন আপনার পরিবারে আনন্দের চেয়ে অধিক বেদনার সৃষ্টি হবে, তা চিরদিন দুঃখের কারণ হয়ে যেতে পারে। আনন্দ করার সময় এমন অসতর্ক থাকা উচিৎ নয় যা পরবর্তীতে সারা জীবন কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জোঁয়ারের সময় গোসল করলে কোন সমস্যা নেই। তবে ভাল সাঁতার না জানলে অতি উৎসাহিত হয়ে সমুদ্রের বেশি পানিতে যাওয়া ঠিক হবে না। বন্ধুদেরকে কৃতিত্ব দেখাতে গিয়ে এবং নিজে বেশি ক্রেডিট নিতে গিয়ে অধিক পানির সমুদ্রের দিকে গেলে আপনার জীবন বিপন্ন হতে পারে। ঢেউয়ের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে যে কোন বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। সাঁতার জানা থাকুক বা না থাকুক সব সময়ের জন্য লাইফ জ্যাকেট নিয়ে সমুদ্রে নামা উচিত। যখন চায়বেন তখন লাইফ জ্যাকেট পাবেন খুব সহজেই। সৈকতের সেবক ও অনেক এনজিও কর্মী আপনাদেরকে সাহায্য করার জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছে। সাগরের পানি লবণাক্ত। অনেকসময় লবণাক্ত পানিতে গোসল করলে চুলে জট বাঁধতে পারে। কালো শরীর আরো কালো হতে পারে। ফর্সা হলে তো কোন সমস্যা নেই। শরীরে সাদা সাদা লবণের চিহ্ন লেগে থাকতে পারে। তবে এনিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই। হোটেলে এসে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে গোসল করলে সকল সমস্যার সমাধান হবে। আপনার পূর্বের গড়নে ফেরৎ যেতে পারবেন। এতে শরীরের কোন ক্ষতি হবে না।
বলতে বলতে বেলা শেষ, এবার হোটেলে যাওয়ার পালা, ক্ষিধেও হালকা পেয়েছে। শরীরে লেগে থাকা লবণ পানি, সামান্য বিরক্তি লাগছে। হোটেলে যাওয়ার পূর্বে একটু ভাবা যাক আর কিছু বাকী আছে কি না, আছে তো। বন্ধুদের নিকট হতে শোনা গল্প সূর্যাস্ত দেখতে খুবই সুন্দর ও আনন্দ লাগে। না দেখে কি ফেরা যায়? যায় না। লবণ পানিতে ভেজা শরীর, কাপড় চোপড়ও, ভেজা, চিন্তা করতে না করতেই আকাশ সামান্য অন্ধকার হতে চলেছে। পশ্চিমাকাশে সূর্য যেন ডিমের কুসুমের মত দেখাচ্ছে। প্রদীপের নিভু নিভু ভাব। নজরকাড়া সূর্যাস্ত ক্যামেরাটি নিয়ে অনেকগুলো ছবি তোলা হল। মনে পূর্ণতা পেল ককস্বাজার ভ্রমণের।
সৈকতের বালিতে হাঁটা, দৌড়ানো ও সাগরের লবণাক্ত পানিতে গোসল করে কান্ত ও পরিশ্রান্ত। সন্ধ্যা নামার পূর্বে বা কিছুক্ষণ পরে হোটেলে যেতে হয়। ঘোরার সময় ঝিনুক মার্কেট হতে সাগরের পাড়ে ও সাগরের তলদেশে হতে আহরণ করা ঝিনুকের নানা সৌন্দর্যের শো-পিচ মনের চাহিদা মত কিনতে পারেন। যা দিয়ে ঘরে ফেরার পর নিজের ঘর সাজানো যাবে, কিছু বন্ধুদের উপহার দিলে সকলে আনন্দ পাবে। ঐতিহাসিক বৌদ্ধ বিহার আরো কয়েকটি মনোমুগ্ধকর স্থান দেখা না হলে বাস্তবেই অপূর্ণ থেকে যায় ককস্বাজার ভ্রমণ। প্রাচীনকাল হতে এ অঞ্চলে বৌদ্ধ রাখাইন সম্প্রদায়ের বসবাস। তাঁদের সংস্কৃতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য, উপাসনালয়গুলো অন্যরকম সৌন্দর্য ও দৃষ্টিনন্দন। এখানে দেখতে পাওয়া যায় অনেক দিন পূর্বে হতে অতি যত্নসহকারে সংরক্ষিত গৌতম বুদ্ধের মুর্তি, মনোরম শৈল্পিক চিত্রাংকন ও কারুকার্যে ভরা অসংখ্য বৌদ্ধমন্দির বা ক্যাং। তৎমধ্যে কয়েকটির অবস্থান বার্মিজ মার্কেটের আশেপাশে, যেমন ঐতিহাসিক ‘অগ্নমেধা ক্যাং’, এর ঠিক পিছনে রয়েছে ‘উইমাথারা ক্যাং’ এবং কেন্দ্রীয় মহাসিনদোগ্রী, আরো একটু দক্ষিণে ‘টং ক্যাং’ আর সামান্য পশ্চিমে রয়েছে ‘চেংহামেজু ক্যাং’। হিলটপ সার্কিট হাউজ পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ‘ম্রাইনাঃ ক্যাং’ যা স্থানীয়দের কাছে ‘বাহারছড়া ক্যাং’ নামে অধিক পরিচিত। ‘জাদিরাং’ এবং ‘পিটাকেট ক্যাং’ নামে আরো দুইটি ক্যাং রয়েছে কক্সবাজারের প্রাণকেন্দ্রে। হিমছড়ি ককস্বাজার কলাতলী মোড় হতে ১৩ কিঃ মিঃ দক্ষিণে দৃষ্টি নন্দন আর এক আকর্ষণীয় স্থান হিমছড়ি। সাগর এবং পাহাড় যেন একসাথে দুলছে। মনে হবে পাহাড়ের পাদদেশে মিশে আছে সাগরের বিশাল জলরাশি। ঢেউ যেন মিনিটে মিনিটে হিমছড়ির পাহাড়ে ধাক্কা মারছে। গল্প আছে কোন এক সময় হিমছড়িতে সাগরের পানি পাহাড়ের সাথে মিশে যেত। সাগরে জোয়ারের সময় লোকজন এপার হতে ওপারে যাতায়াত করতে পারেনি। হিমছড়ির মূল আকর্ষণ প্রাকৃতিক ঝর্ণা। পাহাড়ের বিশাল জলরাশি অনেক উচু হতে সমতলে পড়ার অপরূপ দৃশ্য দেখলে মন জুড়ে যায় খুব সহজে। ভ্রমণ পিপাসুদের মধ্যে অনেকে হিমছড়ির ঝর্ণার পানিতে গোসল করতে বেশি পছন্দ করেন। হিমছড়ির ঝর্ণাকে নিয়ে অনেক গল্প, রূপকথা, গান ও কবিতা লেখা হয়েছে। হিমছড়িকে। কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে অনেক বড় পর্যটন কেন্দ্র। গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা রয়েছে। আরো রয়েছে মনোরম পরিবেশে হোটেল রেস্টুরেন্ট ও পিকনিক স্পট। পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হয়েছে সুন্দর শিশু পার্ক। স্থাপত্য শিল্পীগণ মনোমুগ্ধকর ও নানা রকম কারুকার্য দিয়ে অসংখ্য সিঁড়ি বানিয়েছেন। সেসব সিঁড়ি বেয়ে সমতল হতে পাহাড়ের চূড়ায় উঠা যায় অতি সহজে। উপভোগ করা যায় পাহাড়ের চুড়া হতে সাগরের সৌন্দর্য। রাস্তার পশ্চিম পাশে বসে সাগরের ঢেউ দেখা, পূর্ণিমার রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার মধ্যদিয়ে রাত কাটানো মনে হবে এইতো মাত্র সন্ধ্যা হল। গল্প শেষ হতে না হতেই সূর্যাস্ত দেখা যাবে, মন ভরে দু’নয়নে। ভ্রমণে একসাথে পাহাড় ও সাগরের উত্তাল ঢেউ এবং প্রাকৃতিক ঝর্ণা দেখার সুযোগ খুব কম সময় হয়। শুধু হিমছড়িতে এ অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। ইনানী বিচ কক্সবাজারের আরেকটি সৌন্দর্য ইনানী বিচ যা না দেখলে ভ্রমণে কক্সবাজারের অপূর্ণতা রয়ে যায়। ইনানী বিচ কক্সবাজার শহর হতে ৩৩ কিঃ মিঃ দক্ষিণে অবস্থিত। দীর্ঘদিন যাবৎ ইনানী বিচ বিখ্যাত ছিল। ইতোপূর্বে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পর্যটকদের ইনানী বিচ ভ্রমণে অসুবিধা হতো, বর্তমানে যোগাযোগের জন্য নির্মিত হয়েছে অত্যন্ত সুন্দর মেরিন ড্রাইভরোড, ভোজনের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক রেস্টুরেন্ট, আধুনিক ও উচ্চ মানের কটেজ এবং মোটেল। আছে বিশ্বমানের পাঁচ তারকা আবাসিক হোটেল সি পার্ল (Hotel Sea Pearl) সহ আরো অসংখ্য আবাসিক হোটেল। যেখানে রয়েছে দৃষ্টি নন্দন শিশু পার্ক, হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য নিজস্ব হেলিপ্যাড। ইনানী খালের মোহনাটি একটি দ্বীপাকৃতির বিচ, যাতে আছে শুকনো ঝরঝরে বালুকণা, সাগরের স্বচ্ছ পানি, পানিতে এবং তীরে রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় কালো পাথর। সাগরের ঢেউ পাথরের গায়ে সজোরে ধাক্কা লেগে পানি ছিটকে পর্যটকদের গায়ে পড়ে। সে পানিতে সুন্দর জামা ভেজে যায়, তাতেও অনেক আনন্দ। সাগরে গোসল করা যেমন আনন্দ তার চেয়ে বেশি আনন্দ সাগরের পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের পানিতে গোসল করা। এতে ভিন্ন সাধও উপভোগ করা যায়। এক পাথর হতে অন্য পাথরে ঘুরে বেড়ানো অসাধারণ মনে হয়। কোন কোন সময় এক পাথরে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরা হাত ধরার চেষ্টা করেও ধরা সম্ভব হয় না। মনে হয় একে অপরকে হারিয়ে ফেলছে। আবার মূহুর্তের মধ্যে সে পানি কমে যায়, তখন সব কিছু ঠিকঠাক, আনন্দ আর আনন্দ। এভাবেই পরিবার পরিজন ও বন্ধুদের নিয়ে সারাটা দিন কেটে যায় ইনানী বিচে। বিকাল বেলা হোটেলে ফেরার পালা, কিন্তু না। ফিরব না কুদুম গুহার দর্শন না দিয়ে। পাটোয়ার টেক পাটোয়ারটেক আরেক সৌন্দর্যতম স্থান ককস্বাজার জেলার। সৈকতে মেরিনড্রাইভ রোডে ইনানী বিচ পার হলে চোখে পড়বে পাটোয়ার টেক। যেখানটা গাড়ি থামিয়ে একবার হেঁটে দেখতে ইচ্ছে করবে। সৈকতের তীরে ছোট ছোট পাথরের অনেক লম্বা বাঁধ। মনে হবে হাজার হাজার শ্রমিকের দ্বারা এ বাঁধ সরকার তৈরি করেছে সমতলকে সাগরের ঢেউ হতে রক্ষা করার জন্য, আসলে তা নয়। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি ছোট পাথরের অনেক লম্বা বাঁধ সবার মন কেড়ে নেয়ার মত। তাছাড়া কথিত আছে, পাটোয়ার টেকের পাহাড়ে একটি গুহা ছিল। উক্ত এলাকার সামাজিক কোন অনুষ্ঠান হলে সে গুহার সম্মুখে অনুষ্ঠানের সমস্ত সরঞ্জামাদি জমা হত প্রাকৃতিকভাবে। ঐ সরঞ্জামাদি নিয়ে অনুষ্ঠানের সকল কার্যক্রম শেষে পুনরায় গুহার সম্মুখে রাখলে অমনিতেই চলে যেত। কোন একদিন এক দুষ্ট লোকের বাড়িতে অনুষ্ঠানের জন্য সরঞ্জামাদি নেয়া হলে তা হতে কিছু রেখে দিয়ে অবশিষ্ট মালামাল গুহার সম্মুখে পাঠানো হয়। তার পরবর্তীতে চিরদিনের জন্য উক্ত সরঞ্জামাদি আসা বন্ধ হয়ে যায়। লোকে মুখে সে সব গল্প শুনা যায়। সাগরে যারা মাছ ধরে, তাদের ট্রলার পাটোয়ার টেকের সামনে দিয়ে প্রায়শ যাতায়াত করে। তাঁদের মুখ হতে শোনা গল্প, ট্রলার টেকনাফের দিক হতে ককস্বাজার যাওয়ার সময় পাটোয়ার টেকের ঠিক টেকের সামনে আসলে সাগরের পানি বাঁধের মত উঁচু বলে মনে হয়। একইভাবে বিপরীত দিক হতে আসার সময়ও উক্ত স্থানে পৌছা মাত্রই একই পরিস্থিতি মনে হয়। তাই সবাই পাটোয়ার টেকের সামনে ট্রলার চালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের নৌকার/ট্রলারের গতি কমিয়ে দেয়। যেমনি করে কোন পাহাড়ে গাড়ি উঠার সময় গাড়ির গতি কমে যায়। সে গল্প এলাকায় লোকে মুখে শোনা যায়। সাগরের পানি যেখানে উঁচু মনে হয় ঠিক একই জায়গায় তীরে অনেক বড় বড় পাথরও দেখা যায়। জোয়ারের পানিতে কিছু কিছু পাথর ডুবে যায়, আবার অনেক পাথর দেখা যায় ডুবে না, যেখানে পর্যটকগণ নিজের ইচ্ছে মত আপনজনকে নিয়ে আনন্দ করেন। পাটোয়ার টেক গ্রামের পাহাড় অনেকটাই উঁচু, মনে হয় সাগরের সাথে মিশে আছে। ভ্রমণকারী তাঁর জীবনের সকল দুঃখ ভুলে কিছু সময় পাঠোয়ার টেকে অতিবাহিত করলে মনে যে প্রশান্তি মিলবে তা দেশের অন্য কোথাও পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বালুকাময় সৈকতের বালি অনেক বড় বড় দানাদার। যে বালিতে সিলিকনের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রচুর খনিজ সম্পদ আছে। পাথর ও বড় দানার বালির সংমিশ্রণ সেখানে সাগরের পানি এত বেশি স্বচ্ছ যে, পানির নিচে সব কিছু খালি চোখে দেখা যায়। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে দৌড়ানো দেখতে পাওয়া যায়। ডিসকভারি চ্যানেলে দেখার পর ঐ সকল দৃশ্য লাইভ দেখতে পাটোয়ার টেকে ভ্রমণ করা যায়। চলতে চলতে পৌঁছানো হল উখিয়া উপজেলার সমস্ত সৈকত শেষ করে টেকনাফ উপজেলার সীমানায়। উখিয়ার শেষ সীমানা মনখালী গ্রাম। অনেক বছর পূর্ব হতে মনখালী খালের তীরে বঙ্গোপসাগরের অতি নিকটে ফরেস্টের সুন্দর দৃষ্টিনন্দন বাংলো। তার পশ্চিমে বিস্তৃত এলাকা ঝাউবন, পরে সে বালুকাময় সৈকত। মনখালী খালের উপর দুটি সুন্দর সেতু। সে খালে জোয়ারের সময় পানি ভরপুর থাকে। ভাটা হলে পানি নেমে যায়। পূর্ণিমা রাতে মনখালী খালের সেতুতে দাঁড়িয়ে সাগরের দিকে তাকালে মনে হয় সাগর ও খালের মিলন স্থানটি অন্য একটি বড় লেকে পরিণত হয়েছে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে দক্ষিণা বাতাসের বেগে সৃষ্ট ঢেউগুলোর নড়াচড়া যেন সন্ধ্যাকালীন অন্ধকারে অনেকগুলো জোনাকী পোঁকা একসাথে ঘুরে বেড়ানোর মত দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ছোট ছোট ঢেউ আর সে ঢেউ যেন হেলে দোলে সুন্দরী এক কিশোরী রমণী পায়ে নুপুর, হাতে চুরি পরে রবীঠাকুরের সঙ্গীতের সুরের তালে তালে নেচেই চলছে। কিছু কিছু সময় নদীতে মাছগুলো দৌড়ে বেড়ানোর অপরূপ দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, যা অন্য কোথাও দেখা যায় না। জোস্নার আলোক রশ্মি ভরপুর পানিতে পড়ার পর নদীর মোহনাটি যেন তার ভরা যৌবনটি পুনরায় ফিরে পেয়েছে মনে হয়। আপনজনকে নিয়ে ব্রীজের উপরে বা তার পাশে কোন এক নির্জন জায়গায় বসে অজানার কাল্পনিক সময়টুকু অতিবাহিত করে বাড়িতে গিয়ে সেটিকে কল্পনা করে চোখ দুটি বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লে গভীর ঘুম আপনার মনকে ভাল করে দেবে। লাল কাঁকড়ার সন্ধানে সৈকতে ভাঁটার সময় পানি নেমে যাওয়ার পর তীর অনেক বড় হয়। বালি ভেজা ও তুলতুলে থাকে।
হাঁটার সময় পায়ের সামনের অংশ এবং পিছনের কিছু অংশ ভেজা বালিতে দেবে যায়। খালী পায়ে হাঁটতে ভাল লাগে। বলুকাময় সৈকতে কোথাও একটু কাদা বা ময়লা নেই যে, পায়ে লেগে থাকবে। সৃষ্টির অপরূপ খেলা কোথায় যেন লুকিয়ে থাকা অপরূপ সুন্দর লক্ষ লক্ষ লাল কাঁকড়া ঝাঁকে ঝাঁকে আর্বিভূত হয়। হঠাৎ বালির ভেতর হতে বেরিয়ে আসে, আবার মানুষ দেখলে লজ্জায় নরম ভেজা বালিতে সামান্য গর্তে মুহুর্তের মধ্যে কোথায় যেন লুকিয়ে যায়। তাড়া করলে চোখ দুটো তুলে সাগরের ঢেউয়ের পানির দিকে দৌড় দেয়। বালিতে আড়াল হওয়ার দৃশ্য অনুসরণ করে তাড়া করতে হয়, লোকানোর স্থানটি সনাক্ত করে সামান্য বালি কুড়লে সে কাঁকড়া ধরা যায়। ধরার সময় দু’পা দিয়ে কামড় দেয়ার চেষ্টা করে। কাঁকড়া চোখে চারদিকে দেখতে পায়। সে জন্য সঠিকভাবে ধরতে না জানলে এত জোরে কামড় দেয় যে, অনেক সময় রক্তও বের হয়। কৌতুহল বশত কাঁকড়া ধরতে গিয়ে কামড়ে কষ্ট পেলেও ধরার পর সে কষ্ট সহজে ভুলে যায়। তবুও একবার ধরতে ইচ্ছে করে, ধরতে পারলে অনেক আনন্দ পাওয়া যায়। যতই কামড়ায় না কেন সে কাঁকড়াকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। দু’একটিকে ধরে বাসায় নিয়ে পায়ে দড়ি বেঁধে ছেড়ে দিলে এদিক সেদিক দৌড়ায়। দড়ি টান দিলে আবার পাওয়া যায়। এভাবে খেললে অনেক আনন্দ উপভোগ করা যায়। তাছাড়া না ধরে কাঁকড়ার ঝাঁককে তাড়া করলে মুহুর্তের মধ্যে বালিতে ঢুকে পড়ে, আবার পিছনে ফিরে তাকালে সে সুন্দর লাল কাঁকড়ার দলকে পুনরায় দেখা যায়। ছোট শিশুরা এসব কাঁকড়ার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় ক্লান্ত হয় ও অনেক আনন্দ পায়। রাতে সে কাঁকড়া সৈকতের শুকনো বালিতে অনেক গভীর গর্ত করে ঘুমায়। শিয়াল মামা রাতে সে গর্ত খুঁজে বের করে, গর্তের মধ্যে লেজ ঢুকালে কাঁকড়া কামড়ে ধরে। কাঁকড়ার কামড় খেয়ে শিয়াল লেজ জোরে টেনে বের করলে কাঁকড়াও বের হয়ে আসে। তখন শিয়াল মামা সে কাঁকড়া মজা করে খায়।
শামলাপুর বিচ :
চলতে চলতে শেষ হল উখিয়া উপজেলার সবটুকু গ্রাম। শুরু হল টেকনাফ উপজেলার দৃষ্টি নন্দন শামলাপুর গ্রাম দিয়ে। যে গ্রামে রয়েছে লেখকের কল্পনা ও গল্প কাহিনী অবলম্বণে বাস্তবের কুদুম গুহাটি। ককস্বাজার হতে টেকনাফ পর্যন্ত বালুকাময় সৈকতের একটি বড় অংশ রয়েছে শামলাপুর সৈকতে। আকার ও আয়তনে অনেক বড় আকৃতির এ বিশাল সৈকতে হাজার হাজার পর্যটক ঘুরে বেড়ানো কোন সমস্যাই নেই। সৌন্দর্য, আকর্ষণীয় ও রূপের সমাহার যে কোন ভ্রমণকারীদের শুধু মুগ্ধই করবে না, তাঁদের দীর্ঘদিনের অশান্ত মনকে শান্ত করে দেবে। শামলাপুর সৈকতে আরো রয়েছে হাজার হাজার মাছ ধরার ট্রলার যা দিয়ে প্রতিদিন সাগর হতে টাটকা মাছ ধরে জেলেরা। সাগরের টাটকা মাছ দিয়ে শামলাপুর বাজারে রেস্টুরেন্টগুলোতে দুপুরের খাবার ক্লান্ত মনকে মুহুর্তের মধ্যে জাগিয়ে তুলবে। জোস্না রাতে সৈকতের শুকনো বালিতে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডার ছলে মোবাইল ফোনে ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশ বিদেশে অপরাপর বন্ধুদের সাথে আলাপ করতেও অনেককে দেখা যায়। শামলাপুর বাজারে দুপুরে খাবারের পর কুদুম গুহা দর্শনে বাজারের পূর্বের দিকে হোয়াইক্যং রোড় দিয়ে যেতে হয়। কিংবদন্তীর কুদুম গুহা শামলাপুর বাজারের পূর্ব দিকে হোয়াইক্যং রোড ৩-৪ কিঃ মিঃ, আবার হোয়াইক্যং হতে পশ্চিম দিকে শামলাপুর সড়ক ৫-৬ কিঃ মিঃ পাকা রোড, আধা কিঃ মিঃ পায়ে হাঁটা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে কল্পনার সে ঐতিহাসিক কুদুম গুহা। গুহাটির দর্শনের সময় মনে রাখতে হবে গুহার ভেতর থাকা বাঁদুর ও অন্যান্য প্রজাতির আশ্রিত প্রাণিকে যেন কেহ ধরার চেষ্টা না করেন বা তাড়ানোর চেষ্টা করা ঠিক হবে না। এসব করার চেষ্টা করলে প্রাণিকুল বিলুপ্ত হবে এবং গুহা ও বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হবে। গুহার দর্শন শেষে সাগর কন্যা সেন্টমার্টিন দ্বীপ না দেখে কি ফেরা যায়? না মোটেও না। সারা বছর একবার মাত্র এক বা দু’দিনের জন্য ভ্রমণের সময় পাওয়া যায়। শত চেষ্টা করেও বছরে দু’বার সময় পাওয়া যায় না। কোনভাবেই সেন্টমার্টিন না দেখে বাড়ি ফেরা উচিত হবে না। সে ঐতিহাসিক সেন্টমার্টিন দ্বীপটি একবার ভ্রমণ করলে বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। বলতে বলতে ককস্বাজার হতে টেকনাফ যাওয়ার অর্ধেকেরও বেশি পথ অতিক্রম করা হল। শামলাপুর বাজার পেরিয়ে শীলখালী গ্রাম।
জাহাজপুরা :
তার পর জাহাজ পুরা গ্রামে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য চোখে পড়ে। ভ্রমণে অথবা অন্য কোন কারণে আমাদের দেশ হতে অনেকে বিদেশ যায়। বিদেশ হতে দেশে এসে তাঁদের মুখে বিদেশের সৌন্দর্যের গল্প শুনতে শুনতে অতিষ্ট হতে হয়। বিদেশ ফেরত ব্যক্তি বিদেশের গল্প বলতে বলতে আবেগে আপ্লুত হয়ে যান। বিদেশে যা দেখে এসেছেন বা যা শিখে এসেছেন তা গল্প করতে পছন্দ করেন কিন্তু মানতে পছন্দ করেন না। আমাদের দেশে বিদেশের চেয়ে অনেক সুন্দর স্থান রয়েছে তার বর্ণনা বিদেশীদের নিকট এবং আমার দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের নিকট ভালভাবে উপস্থাপন করার সকল দায়িত্ব আমাদের। আমার দেশে এমন অনেক সুন্দর স্থান রয়েছে যা বিদেশের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। জাহাজপুরার এ দৃশ্যটি কেউ একবার না দেখলে মনে হবে না যে, এটি এত সুন্দর যেখানে রয়েছে মাদার গর্জন ও সেগুন গাছের শত বছরের পূর্বে সৃজিত বাগান। এত বড় মাদার গর্জন গাছ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সচরাচর কোথাও দেখা যায় না। গাছগুলো আকাশের দিকে দাঁড়িয়ে আছে মনে হয় আকাশের মেঘ ছুঁয়ে আছে। লম্বা, সোজা, সাদা অনেক বড় আকৃতির। গর্জন বাগানের মধ্যদিয়ে গাছ না কেটে গাছের ফাঁকা স্থান দিয়ে আঁকা বাঁকা করে সড়ক তৈরি করা হয়েছে তা দেখতে বিদেশের হাজারও দৃশ্যের চেয়ে অনেক বেশি নৈসর্গিক সুন্দর মনে হয়। মন চায় অনেক সময় এখানে প্রিয়জনদের নিয়ে কাটিয়ে দিই। একই স্থান হতে একই সময়ে পাহাড় ও সাগরের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। ছোট অবুঝ শিশু কথা বলতে পারে না কিন্তু ইশারায় তার মনেরভাব ঠিকই প্রকাশ করে। ঘরে থাকতে চায় না, তারা চায় নির্জন মনমাতানো সুন্দর খোলা-মেলা জায়গায় মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে। তাদের জন্য এসব স্থান অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয়। এসব সুন্দর স্থানের কিছু ছবি ও ভিডিও ধারণ করা যায়, যা স্মৃতি হিসেবে চিরকাল থেকে যাবে। গন্তব্য তো টেকনাফ এবং সেন্টমার্টিন। বন ছায়ায় হালকা নাস্তা সেরে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করা যাক। চলমান সময়ে আরো কিছু পথ অতিক্রম করা হল। অনেক অজানা গল্প শোনা হল, নতুন নতুন অপরূপ দৃশ্য দেখা হল যা ইতোপূর্বে দেখা হয়নি কোন দিন।
মাথা ভাঙ্গা :
গ্রামের নামকরণ নিয়ে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে নামকরণ যাই হোক না কেন, গ্রামের সৌন্দর্য অপরূপ যা লেখকের ভাষায় ভালভাবে প্রকাশ করা খুবই কষ্টকর। সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশ হয়ে মেরিনড্রাইভ রোড পশ্চিম দিকে তাকালে মনে হয় অনেক গভীরে বঙ্গোপসাগর। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে এখনই একটি ঢেউ যেন গায়ে এসে পড়ল। আবার পাহাড়ের দিকে তাকালে মনে হবে একটি পাহাড় ক্ষণিকের মধ্যে মাথায় এসে পড়ল। গ্রামের অধিবাসী কর্তৃক সুপরিকল্পিতভাবে সৃজিত সুপারি ও নারিকেল বাগানের অপরূপ সৌন্দর্য দেখলে মন জুড়ে যায়। চলতে চলতে ঐতিহাসিক টেকনাফের সাগর পাড়ে পৌছানো হল। সুন্দর কিভাবে হয় বা কাকে সৌন্দর্য বলে তা উপলব্ধি করতে হলে টেকনাফের সৈকতে ঘুরে বেড়াতে হবে অবশ্যই। গুল্ম লতার বিচরণ, বালুর পাহাড় কোথাও উঁচু কোথাও নিচু সাগরের চলন্ত ঢেউ এর মত দেখতে শুকনো বালির ছোট ছোট স্তুপ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে ইচ্ছে মত দৌড়ানো যায়। বিচ ভলিসহ সবধরণের খেলার মাঠ, কিছুক্ষণের মধ্যে আবার বালি পানিতে ভিজে শক্ত হয়ে ফুটবল খেলার মাঠের মত বিশাল আকারে দেখা যায়, যেখানে সবধরণের খেলাধুলা করা যায়। ভাটায় পানি নেমে গেলে সৈকতের প্রশস্ততা বেড়ে যায়, শুকনো বালি কিছুক্ষণের জন্য শক্ত আকৃতি ধারণ করে। যেখানে সব ধরনের গাড়ি চলাচল করতে পারে। কথিত আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কয়েক স্থানে বিমানের ঘাটি ছিল। সাগরের ঢেউয়ের সাথে সার্ফারেরা আনন্দে মনমাতানো সৌরভে হেলে দুলে সার্ফিং করে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশ হতে ককস্বাজারে এসে সার্ফিংয়ে প্রতিযোগিতা করে।
মাথিনের কূপ:
যাদের মনে অফুরন্ত প্রেম ও ভালবাসা লুকিয়ে আছে তাদের কোমল হৃদয় কখনও কখনও আগ্নেয়গিরির স্ফুলিঙ্গের মত ফেটে প্রিয়জনকে জানিয়ে দেয় তাদের ভালবাসার কথা। আবার মনের ভেতর জমানো দীর্ঘদিনের মাখিন হেরিটেজ ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ ভালবাসা ভয়ে ও লজ্জায় প্রিয়জনকে না বলে চেপে রেখে দেয় অনেকে। না বলা ভালবাসা বেশি সময় পর্যন্ত মনে চেপে রাখতে রাখতে সে হৃদয়টি একদিন ফেটে চুরমার হয়ে যায়। অন্ধকারে রয়ে যাওয়া প্রকৃত ভালবাসার একটি নীরব সাক্ষী টেকনাফ থানার ঐতিহাসিক “মাথিনের কূপ”। থানার বড় বাবু ধীরাজ ভট্টাচার্যের বিরল প্রেম কাহিনী নিয়ে টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডে আজো সফল অবস্থান সে কুপটির। ঐতিহাসিক ‘মাথিনের কূপ’ দর্শন দিলে মনে প্রেমের ভাবাবেগ বৃদ্ধি পাওয়া যেতে পারে। অবাক হওয়া প্রেম কাহিনী নিয়ে রচিত বস্তব ইতিহাসকেও ভালভাবে জানার সুযোগ হতে পারে। ভালবাসার যে মরণ নেই, এমনই একটি ইতিহাস এ মাথিনের কূপ, ইতিহাসের সাক্ষী। রাখাইন সুন্দরী মাথিনের জীবনে এমনই একটি নিষ্পাপ ভালবাসা এসেছিল, যা বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব হয়নি। পশ্চিম বঙ্গ হতে বদলী সূত্রে ১৯২৩-২৪ সালে কম বয়সে টেকনাফ থানার বড় বাবু (ওসি) হিসেবে চাকুরি করতে আসেন বাবু ধীরাজ ভট্টাচার্য। টেকনাফে তখন সুপেয় জলের খুবই অভাব ছিল। থানার বড় বাবুর বাসার সামনে সুপেয় জলের একমাত্র পাকা কূপ। যাকে স্থানীয় ভাষায় পাতকুয়া বলে। যে কূপ হতে থানা এলাকার অনেক পরিবার পানি নিতো পান করার ও ব্যবহারের জন্য। থানার নিকটে অনেক রাখাইন পরিবারের বসবাস। অন্য মেয়েদের সাথে রাখাইন মেয়েরাও নিয়মিত পানি নিতে আসত। রাখাইন সম্প্রদায়ের মেয়েরা সাধারণত সকলে ফর্সা, খুবই সুন্দরী এবং তাদের পরিধেয় পোষাক যে কোন পুরুষকে সহজে আকর্ষণ করার মতো। পরনে একমাত্র থামি (লুঙ্গির মত) এবং গায়ে একটি ব্লাউজ টাইপের জামা, উড়না পরত না কখনো। গোলগাল, ফর্সা মুখে চন্দন মেখে সবসময় বাইরে বের হয়। সাজগোজও বেশ সুন্দর। মাথার লম্বা চুলের বড় বড় খোপা, খোপাটি মাথার উপরের অংশে থাকে। আবার বব কাটিং এবং খোলা চুলের বাহার পুরুষকে সহজে আকৃষ্ট করার মতো। খোলা চুলে কিছু সময় পরপর মাথার ঝাকুনি দেয়া অন্য রকম একটি আকর্ষণ। মৃদু বাতাসে বাহারী খোলা চুলের নড়াচড়া করা কার না দেখতে ইচ্ছে করতো। থানার ঐ কূপে ভোরে লোকজন ঘুম হতে জাগার পূর্বে এলাকার মেয়েরা কলসি কোমরে পানি নিয়ে যেতো। মাথিনও ঐ কূপ হতে নিয়মিত পানি নিয়ে যেতো। বড় বাবু একদিন মাথিনকে দেখে বিস্মিত হন। পরবর্তীতে বড় বাবু তাকে এক পলক দেখার জন্য প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠতেন ও বারান্দায় বসে মনভরে মাথিনকে দেখতেন। চোখে চোখে মনেরভাব আদান প্রদানের পরবর্তীতে উভয়ের মধ্যে ভালবাসা শুরু হয়। এভাবে মাথিন ও বড় বাবুর গভীর প্রেমে পড়ে। এই সংবাদ বড় বাবু ধীরাজ ভট্টাচার্যের মায়ের নিকট পৌঁছায়। মা তাঁর আদরের ছেলের এমন কর্ম সহজে মেনে নিতে পারেননি। তাই তাঁর আদরের ছেলেকে মায়ের অসুস্থতার সংবাদ দিয়ে পশ্চিম বঙ্গে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। আর টেকনাফ থানায় আসতে দেয়নি। এদিকে বড় বাবু আসবেন এ আশায় অর্ধাহারে অনাহারে থাকতে থাকতে মাথিনের জীবন শেষ হয়। মাথিনের সেই স্মৃতি বিজড়িত “মাথিনের কূপ” এক নজর দেখার ইচ্ছে ভ্রমণ পিপাসুদের থাকা অসম্ভব কিছু নয়। টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডে মাথিনের কূপটি স্মৃতি হয়ে এখনো আছে। যারা সত্যিকারে একে অপরকে ভালবাসে তাদের এক নজরে কূপটি দর্শন করা অপরিহার্য। অতপর সেন্টমার্টিন যাওয়ার প্রস্তুতি, কিন্তু আসলে কী তাই? না, এখনও রয়ে গেছে অনেক দর্শনীয় স্থান যা দেখা খুবই প্রয়োজন। এতক্ষণ দেশের নানা কথা, নানা কাহিনী বর্ণনা করা হল। দেশে থেকে বিদেশের সাধ নেয়া গেলে আরো ভাল লাগতে পারে মনে। তাই মায়ানমারের সাধ নিতে হলে ছুটে যেতে হবে নেটং পাহাড়ে। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত একসাথে দেখা ও নাফ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ও মায়ানমারকে বিচ্ছিন্নকারী বিশাল নাফনদী এক সাথে দেখা অনেক আনন্দের। অত্যন্ত কাছ হতে মায়ানমারকে দেখা যায় নেটং পাহাড় হতে। তার পাশে রয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক প্যাগোডা, যেটি দাঁড়িয়ে রয়েছে জাদি মোরা নামক স্থানে। সে প্যাগোডা দর্শন করে সামান্য বিশ্রাম শেষে প্রস্তুতি নিতে হবে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য।
নেটং পাহাড়:
সূর্যাস্ত দেখা হল। এবার দেখা যাক সূর্যোদয়, নাফ নদীর রূপের বাহার ও মায়ানমারের মংডো শহরের সামান্য ছোঁয়া। একসাথে এসব দেখতে হলে যেতে হবে টেকনাফ। শহরতলীর খুবই সন্নিকটে নেটং পাহাড়ে। সাগর পাড় ভ্রমণে শুকনো বালির ঝরঝরে বাতায়নের সাহায্যে শরীরে লেগে থাকা সে বালি পরিষ্কার করতে না করতেই নাফ নদীর স্রোতের সৃষ্ট ঢেউ যেন অপর একটি বড় আকর্ষণ। যা পাওয়া যায় নেটং পাহাড়ের চূড়ায় বসে। ককস্বাজার থেকে টেকনাফ বা সেন্টমার্টিন ভ্রমণ পিপাসুদের টেকনাফ শহরে প্রবেশের পূর্বেই নেটং পাহাড়। যার নিকটেই রয়েছে পর্যটনের সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে মোটেল নেটং। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত আধুনিক ও নিরাপদ নিরিবিলি স্থাপনা। নেটং পাহাড়ে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে তাকালে মনে হয় নাফ নদীর পানি মায়ানমারের মংডো শহরের সাথে একাকার হয়ে আছে। হঠাৎ তাকালে মনে হবে আর একটি বঙ্গোপসাগর। খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে সূর্যোদয় এক নজর দেখার জন্য অনেকেই সেই পাহাড়ে ভিড় জমায়। পূর্বাকাশে ভোরে সূর্যোদয়ের নীলাভ রশ্মি নাফ নদীর পানিতে পড়ে, সে রশ্মি আবার নেটং পাহাড়ের চূড়ায় আপনার গায়ে পড়বে। সে এক অপরূপ মনোরম দৃশ্য। পর্যটকদের সেবা দিতে টেকনাফ পৌর শহরেও গড়ে ওঠেছে বেশ কিছু আবাসিক- অনাবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- দ্বীপপ্লাজা, স্কাইভিউ, নাফ, নিরিবিলি, সম্রাট, রাজমহল, আল-আব্বাছ, নাফ কুইন, নাফ সীমান্ত, আল-করিম, গ্রীণ গার্ডেন, মিল্কী রিসোর্ট, বড়হাজী হোটেল, প্লেজার-ইন্, হিল্টপ। তাছাড়া পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল নেটং, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ, সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত, বনবিভাগ ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের রেস্ট হাউস রয়েছে।
সেন্টমার্টিন :
বিশিষ্ট লেখক হুমায়ুন আহমদের অকল্পনীয় আবিস্কার। তিনি যা বলে গেছেন, যা লিখে গেছেন এবং যা আবিস্কার করে গেছেন, যেটুকু রেখে গেছেন সবটুকুই আমাদের নিকট আছে স্মৃতি হয়ে, চিরকাল থাকবে যা ভুলার নয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপটিকে পৃথিবী ব্যাপী তুলে ধরেছেন আমাদের লেখকগণ। লেখকের মন যেমন সুন্দর ছিল ঠিক তেমনি সুন্দর সেন্টমার্টিন। সাবরাং জেটি, টেকনাফের জেটি যে কোন এক জেটি থেকে স্টিমারে সেন্টমার্টিন যাওয়া যায়। টিকেট বুকিং কেয়ারি সিনবাদ বা অন্য যে কোন শিপিং লাইন্স থেকে দেয়া যেতে পারে। শীতকালে পর্যটকের ভিড় থাকলে স্টিমারের টিকেট অগ্রিম বুকিং ছাড়া সেন্টমার্টিন যাওয়া কষ্টকর হতে পারে। নাফ নদীতে স্টিমারে দেড়-দুই ঘন্টা ব্যাপী সেন্টমার্টিন বেশিরভাগ যেতে সময় মায়ানমারের দৃশ্য দেখা যায়। এক সাথে অনেক স্টিমার ছাড়ে বিধায় এক স্টিমারের যাত্রী অন্য স্টিমারের যাত্রীদের মধ্যে দূর থেকে টা-টার মাধ্যমে আনন্দ করা যায়। বহু পর্যটক স্টিমারে নেচে গেয়ে অন্যদের মনে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেন। নাফ নদীর ছোট বড় ঢেউ পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনার দিকে যেতে থাকলে সেন্টমার্টিন যাওয়ার সার্থকতাটি মৃদু মৃদু উপলব্ধি করা যায়। সাথে থাকা ক্যামেরাটি বার বার খোলতে হয় সাগর ও মায়ানমারের দৃশ্যকে একসাথে করে ছবি তোলার জন্য। মাঝে মধ্যে অপরিচিত অতিথিও আপনাকে ছবি তুলতে সাহায্যের অনুরোধ করতে পারে। অনেকেই স্বেচ্ছায় অন্যের ছবি তোলার সাহায্যের হাত বাড়াতে চেষ্টা করেন। যৌবনের জাগ্রত হৃদয়কে উদ্বেলিত করে নতুন বন্ধু সংগ্রহ করার একটি অনন্য সুযোগ। সম্মিলিতভাবে স্টিমারে করে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে সেই সুযোগটি অনেকে হাত ছাড়া করতে চায় না। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের মধ্যে থেকে নিজের মনের মানুষকে খুঁজে পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ এই ভ্রমণ। অনেক পর্যটক এক সাথে সেন্টমার্টিনে ভ্রমণ করতে তেমন কোন অসুবিধা হয় না। ছবি তোলা ও স্টিমারে নতুন বন্ধুদের খোঁজা শেষ হতে না হতেই সেন্টমার্টিন দ্বীপের জেটিতে এসে হাজির। কার আগে কে নামবে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। কে কোন হোটেলে থাকবে ইতোমধ্যেই অনেকের সাথে ঘটেছে আলাপ পরিচয়। দ্বীপে নামার পূর্বে অনেক কল্পনা, দ্বীপটি কেমন হবে, থাকার ভাল ব্যবস্থা কি আছে, এসব কল্পনা মাত্র। সবাই হৈ-হুল্লা করে নামার মধ্যেও একটি বড় আনন্দ দেখতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ আবার সকালে এসে বিকেলে ফিরে যায়। অনেকে রাত্রি যাপন করেন। জেটি হতে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের দিকে যাওয়ার পথে রেস্টুরেন্টগুলোতে সাগরের তাজা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রান্না করে রাখার দৃশ্য দেখলে জিভে পানি আসে, তখনই খেতে ইচ্ছে করে ক্ষিধে লাগুক বা না লাগুক। ছোট ছেলে মেয়ে সঙ্গে না থাকলে, দিনে এসে দিনে চলে গেলেও দ্বীপটি ভালভাবে দেখে ফিরে যাওয়া যায়। তবে সম্পূর্ণ রূপে দ্বীপকে বুঝতে বা দেখতে হলে ভরপুর চাঁদের আলোতে মধ্য রাতে আপনজনদের নিয়ে পশ্চিমাকাশের তারকা ও সাগরের পানির ঝিলি-মিলি না দেখলে সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেখার সাধ পাওয়া যায় খুবই পরিমিত। বিকেলবেলা দ্বীপের চতুর্দিকে শুকনো ও ভিজে বালিতে হাঁটা, মাঝেমধ্যে হাঁটু পানিতে নামা এবং সাগরের পানিতে গোসল করা সবই আনন্দ। দ্বীপের নারিকেল গাছ হতে ডাব পেরে খাওয়া একটি বাড়তি আনন্দ উপভোগ হতে পারে। দ্বীপটি ভ্রমণের সময় মনে রাখতে হবে যেন দ্বীপের সৌন্দর্য নষ্ট না হয়। যে কোন ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা উচিত। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনায় ভরপুর সাগর-নদী-পাহাড় ঘেরা সীমান্ত শহর টেকনাফ এবং দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। স্বাধীনতার পর ৪৪ বছর ধরে পর্যটকদের জন্য ক্রমান্বয়ে বহুগুণে আকর্ষণীয় হচ্ছে। তবে আধুনিক ও পরিকল্পিত পর্যটন শহর হিসাবে গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন। পরিকল্পিত উপায়ে আধুনিক পর্যটন শহর হিসাবে গড়ে তোলা হলে তা শুধু দেশে নয়, পৃথিবী জুড়ে খ্যাতি অর্জন করা যেত। কারণ, সাগর নদী পাহাড় সমুদ্র সৈকত, সিলিকনে ভরপুর প্রবালদ্বীপ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সমাহার সবকিছুর সমন্বয় এমনটি স্থান আর কোথাও লক্ষ্য করা যায় না। তবে আশা জাগানিয়া খবর হচ্ছে-দেরিতে হলেও সরকার পরিকল্পিত পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে ককস্বাজার পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার একর জমি নিয়ে মাষ্টারপ্লান এর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের অধিবাসী, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীগণ জানান-দ্বীপের মানুষ পর্যটকদের বরণ করতে সদা প্রস্তুত। সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে দেশী বিদেশী পর্যটকগণ নিরাপদে দ্বীপ ভ্রমণ করতে পারবে। পর্যটন মৌসুমে যাতে দেশী বিদেশী পর্যটক শিক্ষার্থীরা নিরাপদে দ্বীপে ভ্রমণ করতে পারেন সেজন্য আইন শৃংখলাসহ সব প্রস্তুতি নেয়া হয়। পর্যটক আগমনকে ঘিরে অপরূপ সাজে সাজানো হয় সমুদ্র সৈকত, জেটি ও দ্বীপের বিভিন্ন প্রাকৃতিক স্পটগুলো। অপূর্ব সুন্দর স্থান সেন্টমার্টিন দ্বীপ। নীল পানি ঘেরা এই দ্বীপের মানুষও অসম্ভব ভালো। চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই এর মত কোন খারাপ ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেনি, সম্ভাবনা নেই। দিন রাত সারাক্ষণ ঘুরতে পারা যায় নির্ভয়ে-নির্জনে। বিশেষত চাঁদনী রাতের দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্য কেবল উপভোগ, অবলোকন ও হৃদয়ঙ্গম করা যায়, লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের সাগর তলদেশে রয়েছে মনোমুগ্ধকর বিচিত্র প্রাণি ও হরেক রকম জীব। রয়েছে নানান আকারের পাথরের স্তুপ, দুর্লভ প্রবাল, পাথরের ফুল। সাগরের জলরাশি ও সৌন্দর্যে ভরা বিচিত্র জীব-প্রাণি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে দেশ বিদেশী পর্যটকদের। সাগরের তলদেশে এসব জীব বৈচিত্র অবাক হবার মতো। দেখলে মনে হবে সাগরের তলদেশে রয়েছে স্রষ্টার সৃষ্ট রহস্যময় এক জগত। যা পর্যটকগণ উপভোগ করতে পারেন। গবেষকদের মতে সেন্টমার্টিনের উপরে যে সৌন্দর্য রয়েছে তার বহুগুণ মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য পড়ে রয়েছে সাগর তলদেশে। উপরে সাগরের সুনীল জলরাশি আর নারিকেল গাছের ছায়ায় ঢাকা বিস্তীর্ণ সাদা বালুকাবেলার চেয়েও সুন্দর এক জগত পড়ে আছে পানির নিচে। এখানে রয়েছে কোরালের পাশাপাশি ছোট ছোট জীব। যা সাগর তলদেশে তৈরি করে বিচিত্র ধরণের বাসা। কোমর পানির নিচে ডুব দিলে দেখা মিলে বিচিত্র কোরাল ও নানা ধরণের শৈবালের। এছাড়া সাগরের গভীরে রয়েছে বিশাল বিশাল বিচিত্র পাথর ও প্রবালের স্তুপ। সেন্টমার্টিনের ছেড়াদ্বিয়া (স্থানীয় ভাষায়-চিরাদিয়া) ভ্রমণ করে এসব সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন যে কোন পর্যটক। দেশের পর্যটন রাজধানী ককস্বাজারের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রতি বছর ভ্রমণে আসেন দেশী বিদেশী কয়েক লাখ পর্যটক। সেন্টমার্টিনের এসব সাগর রত্ন দেখতে হলে অবশ্যই সেন্টমাটিনে অবস্থান করতে হবে। এখানে পর্যটকরা অবস্থান করার সুযোগ সুবিধা রয়েছে অনেক। বর্তমানে মান সম্মত হোটেল মোটেল, কটেজের সংখ্যাও বাড়ছে। তম্মধ্যে উলেখ্যযোগ্য হোটেল এবং কটেজ হচ্ছে-প্রিন্স হেভেন, আল বাহার, প্রাসাদ প্যারাডাইজ, কক্স বাংলা, রোজ মেরী, ব্লু মেরীন রিসোর্ট, ডলফিন, সী আইল্যান্ড, সী ব্লু, ব্লু সী, ব্লু মুন, সীমানা পেরিয়ে, অবকাশ, ড্রীমনাইট, সিটিবি, ডায়মন্ড, আইল্যান্ড প্রাসাদ, প্রিন্স আলবাহার, উশান ভিউ, সমুদ্র বিলাস, স্বপ্নপুরী, স্বপ্ন বিলাশ, সাগর বিলাস, জলপরী, নীল দিগন্ত, নাবিবা বিলাস, পান্না রিসোর্ট, কোরাল ভিউ, সেন্ট রিসোর্ট, রেহানা কর্টেজ, ময়নামতি, দেওয়ান কটেজ, গ্রীন ল্যান্ড, মুজিব কটেজ, শাহজালাল কটেজ, রেজা কটেজ, রিয়াদ রেস্ট হাউস, বে অব বেঙ্গল। শুধু আছে প্রকৃতিক সৌন্দর্য। ড্রেনেজ ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক অসচেতন ভ্রমণকারী ময়লা আবর্জনা যত্র-তত্র ফেলে পরিবেশের সৌন্দর্য নষ্ট করেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন চিরকাল আমাদের জন্য থাকে সে সকল বিষয় মনে রাখা উচিত হবে আমাদের।
সোনাদিয়া:
সে এক রূপ কথার গল্প। ককস্বাজারের দক্ষিণাঞ্চলে ভ্রমণ শেষে শুরু হল উত্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময়। সোনাদিয়া ককস্বাজার শহরের উত্তর প্রান্তে একটি সুন্দর দ্বীপ। বাংলাদেশে একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর করার জন্য সোনাদিয়াকেই নির্বাচন করা হয়। এ দ্বীপের চতুর্পাশে পানি এবং সবদিকে বালুকাময়। ঘুরে বেড়াতে বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। ককস্বাজার বেড়াতে আসা পর্যটকগণ হোটেলে পৌঁছে কোন রকম ব্যাগটি রেখে ফ্রেশ হয়ে ভাল রেস্টুরেন্ট খুঁজে খেতে মন চাইলে প্রথমে যে সুস্বাদু খাবারের অর্ডার দেয়া হয় সেটি হল শুটকি ভর্তা। এ শুটকি যেখানে প্রচুর উৎপাদন হয় তার নাম সোনাদিয়া, সেখানকার শুটকি খেতে খুবই সুস্বাদু। ভোজনপ্রিয় লোকজন অনেকে শুটকি পছন্দ করে থাকেন। পরিচ্ছন্ন সুস্বাদু শুটকি কিনতে হলে এ দ্বীপ ভ্রমণ করা খুবই প্রয়োজন। সোনাদিয়া ভ্রমণ শেষ করে কী বাড়ি ফেরা যায়? না। সোনাদিয়ার অতি নিকটে ঐতিহ্যবাহী মহেশখালীর আদিনাথ পাহাড় ও মন্দির দর্শন না দিলে মনে অপূর্ণতা থেকে যায়। আদিনাথ পাহাড় ও মন্দির দর্শন দিয়ে আসলে ভাল হয়।
আদিনাথ পাহাড় ও মন্দির:
ককস্বাজারের লোকজন কথায় কথায় বলে, ‘কোথায় আদিনাথের পাহাড়, আর কোথায় ছাগলে খের (ঘাস) খার’। এই প্রবাদ প্রবচন আদিকাল হতে শুনেছি, যুগযুগ ধরে চলবে। শ্লোক যেমন স্থানও তেমন। মহেশখালী চ্যানেলের তীর ঘেষে গোরকঘাটা ইউনিয়নে অনেক উঁচু পাহাড়ের উপর এ মন্দির অবস্থিত। পাহাড়ে উঠার সময় অনেকে প্রতিযোগিতা দেন। কে আগে উঠতে পারে। উপরে উঠার পর বিশ্রাম নিতে নিতে গল্প করে অনেক দিন পর এত উঁচুতে উঠা হল, ভালই লাগছে। এখানে প্রতি বছর ফালগুন মাসের ১৪ তারিখ, ২৭ ফেব্রুয়ারি হতে সপ্তাহ ব্যাপী অনেক বড় মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এসময়টি বাংলাদেশের ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য ভ্রমণের একটি অন্যতম সময়। হালকা শীত, নয় গরম নয় ঠান্ডা। আকাশ শান্ত থাকে। সাগর, নদীও শান্ত থাকে। স্বপ্নের রাণীকে খুঁজে নিতে ককস্বাজার ভ্রমণের জন্য এসময়ের পূর্বাপর তারিখ বেছে নিলে একটি নতুন স্থান ও অনেক বড় মেলা দর্শনের সুযোগ হবে নিশ্চয়ই। প্রতি বছর এ মেলায় হিন্দু/সনাতন সম্প্রদায়ের হাজার হাজার পূণ্যার্থী মিলিত হয়। তাছাড়া অসাম্প্রদায়িক এদেশের সকল ধর্মের অসংখ্য লোক এ মেলায় অংশ গ্রহণ করেন। অনেকেই প্রতি বছর আসেন। অনেকে ছোট হতে বড় হয়েছেন স্পিডবোট দিয়ে ছবিতে যুদ্ধ করতে দেখেছেন কিন্তু বিভিন্ন কারণে ভ্রমণের সুযোগ হয়নি। মহেশখালী চ্যানেলে স্পিডবোট দিয়ে ককস্বাজার সহজে আসা যাওয়া করা যায়। এ সুযোগে স্পিডবোটে ভ্রমণের আনন্দও উপভোগ করা যেতে পারে। মেলা শেষে ককস্বাজার ফেরার সময় স্পিডবোটে করে আসলে মাত্র পনের বিশ মিনিট সময় লাগে। স্পিডবোটেও ঘোরা হল, মেলাও দেখা হল। তবে স্পিডবোটে ভ্রমণকালে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করা উচিত।
সম্ভাবনাময় কক্সবাজার:
পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত যার অপরূপ সৌন্দর্যের কথা সহজে বর্ণনা করা কষ্টসাধ্য। অল্প কথায় সামান্য পরিসরে তার রূপের বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তারপরও কিছু কিছু আকর্ষণীয় স্থানের সামান্য সৌন্দর্যের বর্ণনা তুলে ধরা হল, যা খুবই অপর্যাপ্ত। বিশাল এ সৈকতকে বিশ্বের সকল ভ্রমণ পিপাসুদের মন জয় করার জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করে একটি আধুনিক পর্যটন শহর গড়ে তোলা অপরিহার্য। সৈকতের কাছাকাছি এলাকায় কোন স্থাপনা নির্মাণ করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। লোকজন সহজে ইচ্ছেমত রাত দিন ঘুরে বেড়ানোর জন্য খোলামেলা জায়গার সৈকত থাকা প্রয়োজন। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। ককস্বাজার সৈকত হতে টেকনাফের সাবরাং পর্যন্ত “কেবল কার” বা “রোপওয়ে” করতে পারলে দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসুগণ ভ্রমণে এসে ইচ্ছে মত আনন্দ করতে পারতেন। তাছাড়া ককস্বাজার সৈকতের পাশ দিয়ে মেরিনড্রাইভ রোড়ের ন্যায় রেল লাইন টেকনাফ পর্যন্ত স্থাপন করা খুবই জরুরী। যাতে করে পর্যটকগণ “রোপওয়েতে” করে টেকনাফ সেন্টমার্টিন যাবে এবং ট্রেনে করে আবার ফিরে আসবে। ককস্বাজারের মাষ্টার প্লান করে কাজ শুরু করতে পারলে দেশি-বিদেশী উদ্যোক্তারা ককস্বাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন। যতদিন পর্যন্ত মাষ্টার প্লান অনুমোদিত হবে না, ততোদিন বেসরকারিভাবে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চাইবে না। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর ককস্বাজার ও দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে পর্যটন শিল্পের প্রসার শুরু হয় মূলত কয়েক যুগ আগে থেকেই। বিপুল সংখ্যক পর্যটকের পদভারে মুখরিত ককস্বাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে দেখা দেয় আবাসন, বিনোদনসহ নানা সংকট। এ সংকট অবসানে পর্যটকদের সুবিধা দিতে ককস্বাজার থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত গড়ে ওঠেছে শত শত বহুতল ভবন। এতে রয়েছে সৃজনশীল হোটেলসহ বিলাশ বহুল হোটেল। মোটেল জোনের পূর্ব পাশে অনেক গেস্ট হাউস এবং বাণিজ্যিক হোটেল রয়েছে। যাতে পর্যটকগণ স্বাচ্ছন্দে ঐ সমস্ত হেটেলে থাকতে পারেন। আর এর পরিধি বেড়ে ককস্বাজার শহর ছেড়ে বিস্তীর্ণ সৈকত হয়ে অবস্থান করছে দেশের শেষ সীমানা সেন্টমার্টিন পর্যন্ত। পর্যটন শিল্পের অংশ হিসেবে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য গেস্ট হাউস, মোটেল, হোটেল। রাজধানী ঢাকার চেয়েও বেশি সংখ্যক পাঁচ তারকা মানের হোটেল ককস্বাজারেই গড়ে ওঠেছে। নির্মিত হচ্ছে আরো অসংখ্য বিলাশ বহুল হোটেল। এছাড়া স্টুডিও টাইপ তিন তারকা ও পাঁচ তারকা মানের এপার্টমেন্টও রয়েছে অনেক। এসব নির্মাণে ককস্বাজারে বর্তমানে অনেক ডেভেলপার কোম্পানি কাজ করছে। দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। ফলে ককস্বাজার একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপ নিতে যাচ্ছে। সরকারিভাবে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বেসরকারি সংস্থা শেলটেক কনসালটেন্ট যৌথভাবে মাস্টার প্লান তৈরির উদ্যোগ নেয়। ২০১১ সালের ১১ মে মাস্টার প্লানের খসড়া প্রকাশ করে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর। ‘প্রিপারেশন অব ডেভেলপমেন্ট প্লান অব ককস্বাজার টাউন এন্ড সি-বীচ আপ টু টেকনাফ’ নামক প্রকল্পের আওতায় এ খসড়া পরিকল্পনা (মাস্টার প্লান) তৈরি করা হয়। ককস্বাজারের মহেশখালী পৌরসভা ও আদিনাথ মন্দির এলাকা থেকে শুরু করে ককস্বাজার পৌরসভা, ককস্বাজার সদর উপজেলার একাংশ, ককস্বাজার সমুদ্র সৈকত থেকে টেকনাফ সৈকত পর্যন্ত এলাকা, রামু ও উখিয়া উপজেলার একাংশ, টেকনাফ পৌরসভা, সাবরাং ইউনিয়নের একাংশ এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ প্রায় ৮০ হাজার একর জমি নিয়ে মাস্টার প্লান প্রনয়ণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে ককস্বাজার পৌরসভা ও সদর উপজেলার একাংশে হোটেল-মোটেল জোন, খেলার মাঠ, সরকারি অফিস-আদালত, আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, পিকনিক স্পট, এডুকেশন জোন, বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক জোন, সিটি পার্ক, ন্যাচারাল পার্ক, প্রাকৃতিক বনভূমিসহ ইকোট্যুরিজম, রেল স্টেশন, শিল্প এলাকা, ময়লা-আবর্জনার ডাম্পিং জোন, খুরুশকুলে প্রাকৃতিক বন, পার্ক, মৎস্য জোন, ন্যাশনাল পার্ক, মহেশখালীতে পার্ক, ইকোট্যুরিজম, আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, টেকনাফে এক্সকুসিভ ট্যুরিস্ট জোন, সেন্টমার্টিনে ইকোট্যুরিজমসহ নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। ককস্বাজারে অসংখ্য হোটেল রেস্টুরেন্ট রয়েছে এবং সকল হোটেল রেস্টুরেন্টে দক্ষ জনবল রয়েছে। পর্যটনের সরকারি-বেসরকারি হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলো ভ্রমণ করলে দেখা যায় দক্ষ জনবল দ্বারা তাঁরা এ অত্যন্ত সুন্দর ব্যবসা পরিচালনা করছেন। মাঝেমধ্যে ভ্রমণ পিপাসুগণ অপ্রত্যাশিত কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। পর্যটন শিল্পের উপর উচ্চ শিক্ষা বা ডিপ্লোমা করা দক্ষ জনশক্তির সামান্য অভাব পরিলক্ষিত হয় যা পর্যটন শিল্পের ব্যবসার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকে। পর্যটন শিল্পে প্রসিদ্ধ এলাকা বা জেলা শহর শনাক্ত করে সে সকল এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্য সকল বিষয়ের মত পর্যটন শিল্পের ওপর উচ্চ ডিগ্রী অথবা ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে সুদক্ষ জনবল তৈরি করে হোটেল, মোটেল এবং রেস্টুরেন্টগুলোতে শিক্ষিত দক্ষ জন শক্তি নিয়োজিত করতে পারলে বাড়বে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা, আরো বাড়বে সেবার মান এবং ভ্রমণ পিপাসুগণ তাদের মনমত সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। অর্জন করা যাবে সুনাম, বৃদ্ধি পাবে উপার্জন। দেশী ও বিদেশী পর্যটকগণ অনায়াসে ভ্রমণ করতে দ্বিধাবোধ করবেন না। ককস্বাজারের সৌন্দর্যের বর্ণনা ছড়িয়ে পড়বে পুরো বিশ্বময়। ককস্বাজার যাওয়ার সহজ উপায়
কক্সবাজারে সবগুলো দর্শনীয় স্থান খুব স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে দেখে আসা সহজ রোড হচ্ছে- চকরিয়া পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক, রামু ঐতিহাসিক বৌদ্ধ মন্দির, তারপর ককস্বাজার বিচ দেখে রাত্রে হোটেলে থাকতে পারেন, সকালে নাস্তা শেষে হিমছড়ি, দুপুরটি সেখানে কাটিয়ে যেতে পারেন ইনানী বিচ পাটোয়ারটেক, ও তারপর ঐতিহাসিক কুদুম গুহা ও শামলাপুর বিচ, জাহাজপুরা, মাথাভাঙ্গা ও টেকনাফ, নেটং পাহাড়, টেকনাফে রাত্রী যাপন করতে পারেন। থাকার মত অসংখ্য হোটেল আছে সূলভ ও উন্নত মানের। সকালে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। তার পর ককস্বাজার ফিরে এসে রাখাইন সম্প্রদায়ের প্যাগোডা পরিদর্শনের পর আপনি যেতে পারেন সোনা দিয়া দ্বীপ ও মহেশখালী আদীনাথ মন্দির পরিদর্শনে। ককস্বাজার ছয় নং জেটি থেকে স্পীডবোটে স্বল্প ভাড়ায় সহজে সোনাদিয়া ও মহেশখালী যাওয়া যায়। মহেশখালী থেকে দিনেদিনে ককস্বাজার ফিরে ঢাকার বাস ধরতে পারেন। ককস্বাজার বাস স্টেশন বা লালদীঘির পাড় থেকে ঢাকাগামী বাস সবসময় পাওয়া যায়। বিমান সপ্তাহে ২ দিন। বাস এসি, নন এসি সবসময় পাওয়া যায়। বিশেষ করে যারা খুব দ্রুত ও সহজে ককস্বাজার ও সেন্টমার্টিন যেতে চান তাদের জন্য রাত ৯টা নাগাদ ঢাকার ফকিরাপুল বা সায়েদাবাদ থেকে বাসে উঠতে পারলে ভাল হয়। কিছু কিছু বাস কল্যাণপুর, কলাবাগান, গাবতলী হয়েও ছাড়ে, তবে বেশী নয়। আর চট্টগ্রাম দামপাড়া, বহদ্দারহাট, সিনেমা প্যালেস ও বহদ্দারহাট টার্মিনাল থেকে সব ধরণের বাস ছাড়ে। ব্যক্তিগত বা রিজার্ভগাড়ি হলে ঢাকা থেকে সরাসরি ককস্বাজারের লিংকরোড হয়ে অথবা কলাতলী পয়েন্ট দিয়ে মেরিনড্রাইভ রোড হয়ে হিমছড়ি, ইনানী পাটোয়ারটেক, মনখালী, শামলাপুর বিচ, ঐতিহাসিক কুদুম গুহা, শীলখালী, জাহাজপুরা, মাথাভাঙ্গা, টেকনাফ বিচ নেটং পাহাড় হয়ে টেকনাফের দমদমিয়া জাহাজ ঘাটায় পৌঁছাতে সময় প্রয়োজন হবে প্রায় ৮ ঘন্টা, আর চট্টগ্রাম থেকে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘন্টা। লোকাল বাস হলে ককস বাজারের লিংকরোড নেমে টেকনাফের স্পেশাল সার্ভিসের বাস অথবা মাইক্রো বাস ভাড়া করতে হবে অথবা মেরিনড্রাইভ রোড দিয়ে সহজে জেটি ঘাটে পৌছানো সম্ভব হবে। টেকনাফের দমদমিয়া থেকে জাহাজ ছাড়ে সকাল ৯ টায়, ২ থেকে আড়াই ঘন্টায় পৌছবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। তবে মেরিনড্রাইভ রোড দিয়ে যাতায়াত অধিক নিরাপদ ও সময় কম প্রয়োজন হবে। ককস্বাজারের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য পাহাড় ও সাগরের সৌরভ একসাথে পাওয়া যাবে। উল্লেখিত সকল স্থান এত বেশি সুন্দর যে, না দেখলে মনে অনেক আপসোস রয়ে যাবে। ককস্বাজার ভ্রমণের সার্থকতা থাকবে না। বর্তমানে কেয়ারী সিন্দাবাদ, কেয়ারী ডাইন ক্রুজ, এলসিটি কুতুবদিয়া এই ৩টি জাহাজ চালু আছে। এছাড়া ট্রলারে এবং শাহপরীর দ্বীপ হতে স্পীডবোটেও যাওয়া যায়। সেন্টমার্টিনে জাহাজ থেকে নেমে ভ্যান গাড়িতে করে পুরো দ্বীপ ঘুরতে পারবেন। সময় হাতে থাকলে বিকাল ৪টার পরে চিরাদিয়ায় গেলে অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখতে পাওয়া যায়। ঢাকার বাসের টিকেটও পাওয়া যায় জাহাজ ঘাটা থেকে। প্রয়োজনীয় কিছু ফোন নাম্বার: হোটেল সীমানা পেরিয়ে রিসোর্ট এবং এলসিটি কুতুবদিয়া জাহাজ : ০১৯১১১২১২৯২, অবকাশ ০১৭১৩১৪৫৫৮৪, কেয়ারী সিন্দাবাদ ০১৭৩০৯০৮৩৮৫/০১৮১১৪১৮৪৭০, মাছের আড়ত-০১৮২৪৬৫৭৫৮৫। জাহাজ-০১৮১৯৩৭৯০৮৩/
মনে রাখতে হবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২ টা জেনারেটর মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। রিচার্য করতে হয় এমন কোন ডিভাইসের জন্য মাল্টিপ্লাগ ও চার্জার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া আমাদের কাম্য। ককস্বাজার ভ্রমণে আপনার মনে আনন্দ বয়ে আনুক সে আমাদের কাম্য।
এক নজরে কক্সবাজার:
কক্সবাজার জেলা জনসংখ্যা: ২২৮৯৯৯০
পুরুষ: ১১৬৯৬০৪,
মহিলা: ১১২০৩৮৬
মোট খানা: ৪১৫৯৫৪
আয়তন: ৬১৫৭৪৯ একর, বা ২৪৯১.৮৯ বর্গ কিঃ মিঃ, বা ৯৬২ বর্গমাইল।
জনসংখ্যার ঘনত্ব: বর্গ কিঃ মিঃ-৯১৯ জন, বর্গমাইলে: ২৩৮০ জন।
পুরুষ মহিলার অনুপাত: ১০৪:১০০, স্বারতার হার: ৭ বছরের উর্ধ্বে- ৩৯.৩, পুররুষ: ৪০.৩, মহিলা: ৩৮.২।
বার্ষিক বৃদ্ধির হার: ২.৫৫।
ধর্ম ভিত্তিক জনসংখ্যা: মুসলিম-২১৫১৯৫৮, হিন্দু-৯৭৬৪৮, খ্রিষ্টান-১৫০৩, বৌদ্ধ-৩৭৮২২, অন্যান্য-১০৫৯।
নৃগোষ্ঠি জনসংখ্যা: রাখাইন/মারমা-৮০৫৮, তঞ্চঙ্গ্যা-৩৮৬৬, চাকমা-৬৮৬, অন্যান্য-১৯৪১।
পারিবারিক গঠন কাঠামো: ৫:৫।
মহকুমা হয়: ১৮৫৪ সালে, জেলা প্রতিষ্ঠা হয়: ১৯৮৪ সালে।
জেলার প্রধান দ্বীপ সমূহ: মহেশখালী, কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি, সোনাদিয়া, সেন্টমার্টিন।
প্রধান নদী: মাতামহুরী, বাঁকখালী, রেজু, নাফ।
প্রধান চ্যানেল: মহেশখালী, কুতুবদিয়া।
প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন ও দশনীয় স্থান: আদিনাথ মন্দির, শাহ ওমর গম্বুজ, মাথিনের কূপ, রামকুট, বৌদ্ধ ও হিন্দু বিহার, কানা রাজার গুহা, হিমছড়ি, ইনানী সমুদ্র সৈকত। প্রধান উৎপাদিত শস্য ধান, আলু, ডাল, পেঁয়াজ প্রধান অর্থকরী ফসল: পান ও সুপারি। রপ্তানীকৃত দ্রব্য: চিংড়ি, সামুদ্রিক কাঁচা ও শুটকি মাছ। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান: পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, কক্সবাজার, দৈর্ঘ্য-১৫৫ কিঃ মিঃ।
লেখক:
রফিক উল্লাহ্
পুলিশ কর্মকর্তা, লেখক ও গবেষক।












