হিজবুল্লাহপ্রধানকে হত্যায় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয় গত সপ্তাহে

আন্তর্জাতিক

অনলাইন ডেস্ক

লেবাননের শিয়াপন্থী রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে গত সপ্তাহের শুরুর দিকে হত্যার অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা এমন তথ্য জানিয়েছেন।

সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে। সে সময় লেবাননে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসরায়েলের নেতাদের আলোচনা চলছিল। এর পরপরই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিতে যান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

চিরশত্রু ইসরায়েলের হামলায় গত শুক্রবার রাতে নিহত হয়েছেন সংগঠনটির প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ। তিন দশকের বেশি সময় ধরে হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, হত্যার জন্য কয়েক মাস ধরে অনুসরণ করছিল ইসরায়েল। তাঁর অবস্থান সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন দেশটির নেতারা।

ইসরায়েলের তিনজন জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, নাসরুল্লাহকে হত্যা করতে শুক্রবার রাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে ৮০টির বেশি বোমা ফেলা হয়।

ওই তিন কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন নাসরুল্লাহর চাচাতো ভাই হাশেম সাফিয়েদ্দিন। শুক্রবারের হামলার সময় তিনি নাসরুল্লাহর সঙ্গে ছিলেন না। তাঁকে নাসরুল্লাহর উত্তরসূরি বলে মনে করা হয়।

কয়েক মাস ধরে নাসরুল্লাহর গতিবিধি অনুসরণ করছিলেন ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। অনেক বছর ধরে তিনি সরাসরি জনসমক্ষে আসতেন না। ৬৪ বছর বয়সী এই নেতা বিভিন্ন সময়ে টিভিতে দেওয়া ভাষণে অনুসারীদের বার্তা দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হুমকি উল্লেখ করে তিনি ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিতেন।

ইসরায়েল–হিজবুল্লাহর দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো। ২০০৬ সালে একবার যুদ্ধে জড়িয়েছিল তারা। এরপর গত বছর গাজা যুদ্ধ শুরুর পর হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইসরায়েলে হামলা শুরু করে সংগঠনটি। পাল্টা হামলা চালাচ্ছিল ইসরায়েলও। দুই সপ্তাহ ধরে হামলা জোরদার করে ইসরায়েল। এরই মধ্যে গত শুক্রবার রাতে রাজধানী বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালানো হয়।

শুক্রবারের হামলার পর ইসরায়েলি বাহিনীর একাধিক মুখপাত্র জানান, এদিন বৈরুতে হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ অন্য নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। এতে নাসরুল্লাহ নিহত হন। প্রথমে এ নিয়ে কোনো বক্তব্য জানায়নি হিজবুল্লাহ। পরে গতকাল শনিবার তাদের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে নাসরুল্লাহর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

১৯৯২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধান হন নাসরুল্লাহ। মূলত লেবাননের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে দখলদার ইসরায়েলকে বিতাড়িত করতে ইরানের সমর্থনে হিজবুল্লাহর যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায় সংগঠনটি। ধীরে ধীরে তারা দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সশস্ত্র গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। তবে সব৴শেষ ২০২২ সালের নির্বাচনে দেশটির পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় হিজবুল্লাহ ও তার মিত্ররা। এর পরও লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলের সীমান্ত লাগোয়া বড় অংশ হিজবুল্লাহর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলা

লেবাননে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে হামলা শুরু হয় ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর। এ দুই দিনে সংগঠনটির হাজার হাজার পেজার (যোগাযোগের যন্ত্র) ও ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে হিজবুল্লাহর সদস্যসহ বহু মানুষ হতাহত হন। এরপর থেকে ইসরায়েলের সীমান্তবর্তী দক্ষিণ লেবাননে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের দাবি, হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হচ্ছে।

ইসরায়েল শুধু হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করার কথা বললেও তাদের হামলায় নিহত হয়েছে বহু বেসামরিক লোকজন। গত কয়েক দিনের হামলায় লেবাননে নারী, শিশুসহ ৭০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ১ হাজার ৮০০ জনের বেশি। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১ লাখ ১৮ হাজারের বেশি মানুষ।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত হিজবুল্লাহর ১৪০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে তারা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শুক্রবার রাতে দক্ষিণ বৈরুতের হামলা ২০০৬ সালের যুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল।

এ হামলা নিয়ে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেরজি হালেভি গতকাল বলেছেন, ‘আমাদের বার্তাটা একেবারেই সাদামাটা। সেটি হলো, যে-ই ইসরায়েলের নাগরিকদের হুমকি দেবে, আমরা জানি, তাদের কাছে কীভাবে পৌঁছাতে হয়।’ আর নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পর গতকাল হিজবুল্লাহও জানিয়েছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ চলবে।

মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ জেমস ডরসির ভাষ্যমতে, শুক্রবারের হামলা এটাই দেখিয়েছে—ইসরায়েলের শুধু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত সক্ষমতাই নেই, একই সঙ্গে তারা হিজবুল্লাহর অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে।

নাসরুল্লাহকে হত্যা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড

মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ইরানের সমর্থনপুষ্ট প্রতিরোধ বাহিনী বা এক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স রয়েছে, তার অন্যতম শক্তি হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহপ্রধানের নিহত হওয়ার খবরে গতকাল ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেন, হিজবুল্লাহর উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতি করার জন্য ইসরায়েল খুবই নগণ্য। এই অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারণ করবে প্রতিরোধী শক্তিগুলো। এই শক্তির শীর্ষে রয়েছে হিজবুল্লাহ।

নাসরুল্লাহকে হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে হামাস। এই হত্যাকাণ্ডকে ‘কাপুরুষোচিত’ ও ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ বলে উল্লেখ করেছে তারা। আর ইয়েমেনে ইরানপন্থী সশস্ত্র সংগঠন হুতি এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করে বলেছে, নাসরুল্লাহর এই মৃত্যু ‘আত্মত্যাগের শক্তিকে আরও বৃদ্ধি করবে।’

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান লেবাননে হামলাকে ইসরায়েলের ‘গণহত্যা, দখলদারি ও আগ্রাসনের’ নীতির অংশ বলে উল্লেখ করেছেন। এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানিও।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের পক্ষে সাফাই গেয়ে নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ডকে ‘ন্যায়বিচারমূলক ব্যবস্থা’ বলে উল্লেখ করেছেন। হিজবুল্লাহ হাজারো বেসামরিক আমেরিকান, ইসরায়েলি ও লেবানিজকে হত্যা করেছে দাবি করে বাইডেন বলেন, হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুতির মতো ইরানপন্থী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় ইসরায়েলকে সর্বাত্মক সমর্থন দেবে ওয়াশিংটন।

আঞ্চলিক যুদ্ধের শঙ্কা

গত বছরের অক্টোবর থেকে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে উপত্যকাটিতে অন্তত ৪১ হাজার ৫৮৬ জন নিহত হয়েছেন। এরই মধ্যে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর চলমান পাল্টাপাল্টি হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক হারে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

গাজায় সংঘাত থামাতে বারবার যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তা এখনো সফলতার মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে সম্প্রতি ইসরায়েল–হিজবুল্লাহর প্রতি ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি মিত্রদেশ। তবে তা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েল।

মধ্যপ্রাচ্যে হিজবুল্লাহর মতো ইরানপন্থী আরও সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে। গাজায় হামলার পর থেকে তারাও হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এদের মধ্যে ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতি মাঝেমধ্যে ইসরায়েল ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘তেহরানের বিভিন্ন অত্যাচারী বাহিনীর প্রতি আমার একটি বার্তা রয়েছে, সেটি হলো, আপনারা যদি আমাদের ওপর হামলা চালান, আমরাও পাল্টা হামলা চালাব। ইরানের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ইসরায়েলের হাত পৌঁছাবে না।’

পরে নেতানিয়াহুর এমন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনি বলেন, এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও হামলার হুমকি দিয়েছেন। তিনি আরও মানুষ হত্যা করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহ ও ইরানপন্থী অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনের সংঘাত থামাতে আগে গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ভাষ্যও একই। আবারও গাজা ও লেবাননে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই যেকোনো মূল্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ এড়াতে হবে।’