জসিম মাহমুদ, বিশেষ প্রতিনিধি।।
কক্সবাজারের টেকনাফে শাহপরীর দ্বীপে বৈরী আবহাওয়া ও পূর্ণিমার জোয়ারে পানির আঘাতে ১৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত বেড়িবাঁধের অন্তত ১৫ টি স্থানে ধসে পড়েছে সিসি ব্লক। এতে বেড়িবাঁধের টেকসই ও স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বেড়িবাঁধে ধস ও বেড়িবাঁধ টপকে কয়েকটি গ্রামের বসত বাড়িতে ঢুকে পড়েছে জোয়ারের পানি। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় প্রায় ৪০ হাজার মানুষের মধ্যে।
এই দৃশ্য দেখে স্থানীয় আবদুল গনি (৬০) বলছেন-এ কেমন ব্লক, সামান্য জোয়ারের পানির ধাক্কায় ভেঙ্গে যাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছাস হলে অবস্থা কী হবে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না! আবারো কি তাহলে শাহপরীর দ্বীপের ৪০হাজার মানুষের কপালে দু:খ ঘনিয়ে আসছে।
আজ রবিবার সকালের দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, শাহপরীর দ্বীপ তিন রাস্তার মাথার এলজিইডির সংযোগ সড়ক দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে বেড়িবাঁধের অবস্থান। বাঁধের পূবপাশের আবুল হোসেনের বাড়ি সংলগ্ন এলাকা থেকে দক্ষিণপাশে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ১৫ টি জায়গায় সিসি ব্লক ধসে পড়ছে। বেড়িবাঁধের ঢালুতে অন্তত ২৫থেকে ৩০টি এবং নিচের একাধিক অংশের সিসি ব্লক সরে যাচ্ছে সামান্য জোয়ারের ধাক্কায়। বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাড়া থেকে দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত আরও এক কিলোমিটার অংশে একাধিক জায়গায় (নিচে স্থাপিত) সিসি ব্লক ধসে পড়েছে। ধসেপড়া অংশের ফাঁকে ফাঁকে বালুর জিও ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও জেলেরা জাল মেরামত করছেন। আবার কেহ দলবেঁধে বিভিন্ন বয়সের কিশোর, যুবক ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা বেড়িবাঁধের ওপর আড্ডা দিচ্ছেন। পশ্চিমপাড়া, মাঝেরপাড়া থেকে দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত নিমিত প্রায় তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে পড়েছে। তবে ঘোলাপাড়া অংশে জোয়ারের আঘাতে হুমকির মুখে পড়েছেন।
এসময় কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল আমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন,গতরাতে হঠাৎ করে পূর্ণিমার জোয়ারের পানি বেড়ে গিয়ে ঢেউয়ে এসে বাঁধের উপর ব্লকের আঁছড়ে পড়ছেন। এতে করে ব্লকগুলো সরে যাচ্ছে। জোযারের পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে গতরাতে এলাকার মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এলাকায় ।
দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ তারেক বলেন,বাঁধ নির্মাণ করে কোটি কোটি টাকা জলে ফেলা হচ্ছে। বছর ঘুরে আসতেই ব্লকগুলো ধসে পড়ছে।বড়ধরনের ক্ষতির আগেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, গত কয়েক বছরে এখানকার অনেক মানুষ জমিজমা ও বসতঘর হারিয়েছেন। সাগরে বিলীন হয়ে গেছে দক্ষিণপাড়া ও পশ্চিমপাড়া। এরপর ২০১৯সালের জানুয়ারি থেকে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হলে এলাকার শত শত লোকজন আশার আলো দেখতে পেলেও বাঁধের সিসি ব্লক ধসের খবরে আবারো স্থানীয়রা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফলতির কারণে এ অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে।
সাবরাং ইউপির ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মন্নান বলেন,বেড়িবাঁধ নির্মাণে প্রথমদিকের কাজগুলো টেকসই ছিল,কিন্তু দক্ষিণপাড়া অংশে যেখানে সাগরের আগ্রাসন বেশি, সেখানে এসে কাজে তাড়াহুড়া করে কাজ করায় কাজের মান তেমন ভালো হয়নি। প্রতিরক্ষা ব্লক স্থাপিত করার প্রথম বছরের শুরু থেকে ব্লকগুলো ধসে পড়ছে।বর্তমানে জোয়ারের ধাক্কায় সিসি ব্লকগুলো প্রতিনিয়ত ধসে পড়ছেন।এভাবে চলতে থাকলে আসন্ন র্বষা মৌসুমে বাঁধটি বিলীন হওয়ার পাশাপাশি সিসি ব্লক ধসেপড়ার আশঙ্কা রয়েছে।এতে করে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
শাহপরীর দ্বীপরক্ষা ও উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও এলাকার প্রবীণ শিক্ষক জাহেদ হোসেন বলেন, মৎস্য আহরণের অন্যতম স্থান শাহপরীর দ্বীপ এখন আতঙ্কগ্রস্ত একটি জনপদ।গত কয়েক বছরে জলোচ্ছ্বাসে শাহপরীর দ্বীপের প্রায় ১০হাজার একরের চিংড়িঘের ও ফসলি জমি সাগরগর্ভে তলিয়ে গেছে।বিলীন হয়েছে,মসজিদ-মাদ্রাসা অন্তত চার হাজার ঘরবাড়ি।দুই বছর আগে নিমিত বেড়িবাঁধটির সিসি ব্লক আবারও ধসে পড়ায় শাহপরীর দ্বীপের লোকজনকে ঝুঁকি ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বেড়িবাঁধ রক্ষা করতে হলে আরো বেশি বেশি সিসি ও ডাম্পিং ব্লক দেওয়া দরকার।
দক্ষিণ পাড়া গ্রামের দুধু মিয়া বলেন, বিগত কয়েক বছর এলাকার প্রায় তিন হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল।এতে পাঁচ শতাধিক লবণচাষির পরিবার ছিল আতঙ্কে। কিন্তু আবার নতুন করে বেড়িবাঁধের ব্লক ধসেপড়ার খবরে স্থানীয় লোকজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। দুই দিন আগে বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে পানি পার হওয়ায় মানুষ বেশি আতঙ্কে রয়েছে।
শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা বনি আমিন বলেন,বিগত কয়েক বছরে বেড়িবাঁধ ভাঙনের ফলে কয়েক হাজার মানুষ বাপ-দাদার ভিটি-জমি ছেড়ে টেকনাফসহ অন্যত্রে চলে গেছে। প্রতিবারই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফলতির কারণে বাঁধে স্থাপিত সিসি ব্লক ধসে পড়েছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার পরও স্থানীয় বাসিন্দারা শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। তবে এতে করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পকেট ভারী হলেও সর্বনাশ হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। তারা হারাচ্ছেন বাড়িঘর ও জমিজমা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড(পাউবোর)টেকনাফে উপসহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন,নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এবং পাউবোর নিয়মিত তদারকিতে বেড়িবাঁধটি কাজ শেষ হয়েছিল। তবে বর্তমানে জোয়ারের পানিতে বাঁধের সিসি ব্লকগুলো সরে যাচ্ছে। আগামী ২১ অক্টোবরের মধ্যে সাগরে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার আবহাওয়ার পূব সতর্ক বার্তা রয়েছে। এর প্রভাবে গত রাতে পূর্ণিমার জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ১০-১২ফুট বেড়ে যাওয়ায় বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে লোকালয়ে জোয়ারের ঢুকে পড়ে। এতে করে বেড়িবাঁধের ব্লকগুলো ধসে পড়েছে।
প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, বিভিন্ন সময়ে ব্লক ধসে পড়ায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০মিটারের নতুন ব্লক বসানোর জন্য মেসার্স শহিদ ব্রাদার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ বরাদ্দ পেয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ব্লক নির্মাণ ও স্থাপনের কাজ শুরু করবেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবোর) কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্র জোয়ারের উচ্চতা বেড়ে গেছে। শাহ পরীর দ্বীপ নির্মিত বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে বেজা বড় বড় পাইপ দিয়ে নাফ নদী থেকে বালি উত্তোলনের সময় বেড়িবাঁধের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন অংশে ব্লক সরে যাচ্ছে। বাঁধটি নির্মাণ করার সময় চরটা অনেক দূরে ছিল। সাগরের অব্যাহত ভাঙনে বর্তমানে বাঁধের কাছে চলে আসায় বড় ঢেউগুলো বাঁধের উপর ব্লকের আঁছড়ে পড়ছেন।তাই ব্লক ধসে পড়ছে। সেখানে নতুন করে আরও অতিরিক্ত ব্লক ফেলে ভাঙন/ধস ঠেকানোর চেষ্টা করা হবে। এজন্য নতুন করে একটি প্রকল্প বরাদ্দ পাওয়া গেছে। কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত কাজ শুরু করবেন।