পেকুয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি।
কক্সবাজার জেলার ছোট্ট দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া। যার মধ্যে রয়েছে ৬ টি ইউনিয়ন। প্রায় ২১৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট এই দ্বীপে আছে নানান রকম বৈচিত্র্য। নির্জন বেলাভূমি, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র, লবণ চাষ, বাতিঘর, কুতুব আউলিয়ার মাজারসহ আছে দেখার মতো অনেক কত কিছু।
তথ্য সূত্রে মতে, সাগরের বুক চিরে আজ থেকে প্রায় ৬ শত বছর পূর্বে জেগে ওঠেছিল এই প্রবাল দ্বীপটি। রহস্যময় এই দ্বীপে মানুষ প্রথম পা রাখে পনেরো শতকে। মধ্য প্রাচ্য থেকে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে হযরত কুতুবউদ্দীন নামে এক আধ্যাত্মিক সাধক প্রথম এ দ্বীপে আসেন। কুতুবউদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই দ্বীপের নাম করণ হয় ‘কুতুবউদ্দিনের দিয়া’। কুতুবদিয়ায় শিক্ষার হার প্রায় ৮০ শতাংশের কাছাকাছি । যার অবস্থান জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকে অনেক এগিয়ে। স্বভাবতই কুতুবদিয়ার মানুষ খুবই মেধাবী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণ হচ্ছে তারা নির্মল ও মুক্ত হাওয়ায় বেড়ে ওঠে। এ দ্বীপের লোকজন বেশিরভাগ অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী, উচ্চশিক্ষিত ও শান্ত মনের মানুষ। তাই মামলা মোকাদ্দমার হার ও খুবই কম। সব মিলিয়ে কুতুবদিয়া হতে পারে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ ও মনোমুগ্ধকর ভ্রমণের নতুন ঠিকানা। কীভাবে যাবেন এ দ্বীপে- পেকুয়ার মগনামা ঘাট থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে সহজেই কুতুবদিয়া দ্বীপে পৌঁছানো যায়। কক্সবাজার থেকে সরাসরি স্পিডবোটে বা যাত্রী ও মালবাহী নৌযানে করে কুতুবদিয়া যাওয়া যায়। দেশের যেকোনো প্রান্তেই থাকুন না কেন, আপনাকে প্রথমে চট্টগ্রাম শহরে আসতে হবে। এখানকার চান্দগাঁও থানা কিংবা নতুন ব্রিজ থেকে আনোয়ারা, বাঁশখালী দিয়ে পেকুয়া মগনামা বাজারে যেতে পারবেন। এছাড়া চকরিয়া হয়েও যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। ভাড়াটা এখন বেশিই। ডিজেলের দাম বাড়ায় ভাড়াটা সম্ভবত বিরক্তিকর পর্যায়ে ঠেকেছে। এ ছাড়াও চট্রগ্রাম খাতুনগঞ্জ থেকে ও সরাসরি নৌযানে করে যাওয়া যায় কুতুবদিয়ায় এ দ্বীপে।
কি খাবেন কোথায় থাকবেন- কুতুবদিয়ায় ঘুরতে হলে আপনাকে নোঙর করতে হবে বড়ঘোপ বাজারে। এমনিতে পর্যটন এলাকা হিসেবে এই জায়গাটি বরাবরই উপেক্ষিত। উন্নত সুযোগ-সুবিধার অপর্যাপ্ততা তাই সহজেই লক্ষণীয়। এখানে ভালো রেস্টুরেন্ট নেই। তবে বড়ঘোপ বাজারেই কিছু ভালো খাবার হোটেল পাবেন। স্থানীয় মাছ, মাংস, শুটকি দিয়ে রান্না খাবার যথেষ্ট তৃপ্তি নিয়েই খেতে পারবেন। আবাসন নিয়ে নেই কোনো দুশ্চিন্তা। কুতুবদিয়া দ্বীপে পর্যটকদের থাকার জন্য মানসম্মত একমাত্র আবাসন ব্যবস্থা হল হোটেল সমুদ্র বিলাস। সমুদ্র লাগোয়া এই হোটেলে বসে উপভোগ করা যায় সমুদ্রের সৌন্দর্য। এছাড়াও মানসম্মত বেশ কয়েকটি হোটেল ছাড়াও রয়েছে সরকারি ডাকবাংলো।
শীতে কুতুবদিয়ার জমিতে চাষ হয় লবণ। এ সময়ে সেখানে গেলে দেখা যাবে মাঠে মাঠে কৃষকদের লবণ চাষের ব্যস্ততা। দ্বীপের সর্বত্রই কম-বেশি লবণের চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি লবণের মাঠ তাবলের চর, কৈয়ারবিল, আলী আকবরের ডেইল-এ রয়েছে। প্রাকৃতিক উপায়ে লবণ উৎপাদনের নানান কৌশল দেখা যাবে এখানে। এছাড়াও লবণের মাঠের পাশেও ফসলের ক্ষেত, শাকসবজি, ফল ফলাদির বিশাল আবাদি জমি। সেখানেও নারী-পুরুষ-শিশুর ব্যস্ততা।
কুতুবদিয়া চ্যানেল- কুতুবদিয়ার চ্যানেল বেশ বড়। সারা বছর বেশ উত্তাল থাকলেও শীতে মোটামুটি শান্তই থাকে। মগনামা ঘাট থেকে এই চ্যানেল পাড়ি দিয়েই পৌঁছতে হবে দ্বীপে। পূর্ব দিকে খরস্রোতা কুতুবদিয়া চ্যানেল। এই চ্যানেলে সরাসরি নোঙর করে ফিশিং বোট ও নৌযান। এখানে নেই কৃত্রিম ময়লা আবর্জনা ও গিজগিজে হাল।
সমুদ্র সৈকত- কুতুবদিয়ার সমুদ্র সৈকত উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। বেশিরভাগ এলাকাই বেশ নির্জন। পর্যটকের আনাগোনা নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে শুধু আছে জেলেদের কর্মব্যস্ততা। কোথাও কোথাও সৈকতের পাশে আছে ঝাউগাছের সারি। সমুদ্র তীর ধরে একটু দক্ষিণে গেলেই দেখা মিলবে সারিবদ্ধ ঝাউবন, সামুদ্রিক মাছের ছড়াছড়ি, গাংচিলদের এদিক সেদিক উড়ে বেড়ানোর মনোরম দৃশ্য। অসংখ্য জেলে দেখতে পাবেন, যারা জাল আর মাছ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সমুদ্র সৈকতের দিগন্ত জুড়ে বিশাল বালু প্রান্তরে পড়ন্ত বিকেলে শিশু ও যুবকেরা ফুটবল খেলে যাচ্ছে। সমুদ্রের কিনারা ঘেষে রয়েছে শুঁটকি পল্লী বা শুঁটকি মহাল। কুতুবদিয়া সৈকতের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট হল প্রচুর গাংচিল ঘুরে বেড়ায় সেখানে। নির্জনতার সুযোগে সৈকতের কোথাও কোথাও লাল কাঁকড়াদের দল ঘুরে বেড়ায় নির্ভয়ে। সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার জন্য কুতুবদিয়ার সৈকত আদর্শ জায়গা। আর পূর্ণিমার জ্যোৎস্না থাকলে তো আর কথাই নেই। রাতে মাছ ধরার ট্রলারের মিটিমিটি আলো বিক্ষিপ্ত ভাবে থাকায় মনে হবে যেন তারার সমুদ্র এটি।
বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র- বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র কুতুবদিয়ায় অবস্থিত। প্রায় এক হাজার কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এই বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে সৈকতের দক্ষিণ প্রান্তে, আলী আকবরের ডেইল এলাকায়। দেখতে ভুল করবেন না দেশের বড় এই বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেইসঙ্গে দিনের আলোতে ঘুরে আসুন লেমশীখালীতে অবস্থিত কুতুব শরীফ দরবার।
বাতিঘর- কুতুবদিয়া ভ্রমণ স্বার্থক করতে দ্বীপের দক্ষিণ ধূরং এলাকায় অবস্থিত বিখ্যাত বাতিঘর ইস্পাতের কৌণিক দন্ড ব্যবহার করে ১৯৬৫ সালে এই বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। এখানে এর অন্তত একশো বছর আগে আরো একটি বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরানো সেই বাতিঘর সমুদ্রে বিলীন হয়েছে বহু আগে। তবে এখনও ভাটার সময় সেই বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ কখনও কখনও জেগে উঠতে দেখা যায়। পুরানো বাতিঘরের এলাকায় পরে যে বাতিঘর তৈরি করা হয়েছিল সেটিই এখন নাবিকদের পথ দেখায়। বড়ঘোপ বাজার থেকে সমুদ্র সৈকত ধরে উত্তর দিকে কিছু দূর গেলে বর্তমান বাতিঘরের অবস্থান।
প্রয়োজনীয় তথ্য- কুতুবদিয়া দ্বীপে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। জেনারেটর ও সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে এখানকার বৈদ্যুতিক চাহিদা মেটানো হয়ে থাকে। সৈকতে জোয়ার ভাটা চিহ্নিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই নিজ দায়িত্বে জোয়ার-ভাটার সময় জেনে সমুদ্র স্নানে নামতে হয়। ভাটার সময় সমুদ্রে নামা বিপজ্জনক। ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের জন্য কুতুবদিয়া হচ্ছে সৌখিন পর্যটন স্পট। দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক কুতুবদিয়া ভ্রমণে আসেন বিশেষ করে শীত মৌসুমে। এ দ্বীপ প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে ঝুঁকি প্রবণ এলাকা হলেও রূপে অপরূপা। এ কারণে প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে হলে বৈচিত্রময় কুতুবদিয়ার বিকল্প খূঁজে পাওয়া মুশকিল। এখানে পর্যটক কিংবা শহুরে মানুষ নতুন কিছু না। লবনের মাঠে ব্যস্ত কৃষকেরা তবুও মাথা উঁচিয়ে আপনাকে হাসিমুখে দেখবে। লোকজনের আন্তরিকতা এখানে বেশ। শহরের দমবন্ধ অবস্থায় যেখানে কথা বলার লোকের অভাব, সেখানে সুস্থ নিঃশ্বাসের সন্ধানে কুতুবদিয়ার বিকল্প মেলা ভার।