পলিথিন কি পুরোপুরি নিষিদ্ধ হবে?

স্বাস্থ্য

বর্তমানে মানুষের দৈনন্দিন জীবন প্লাস্টিক পণ্য ছাড়া কল্পনা করা প্রায় দুরূহ। প্রায় সব ধরনের পণ্যের মোড়ক ও বোতল প্লাস্টিকের তৈরি। লেখাপড়া এবং অফিসের কাজে ব্যবহৃত কলম থেকে শুরু করে সব দামি প্রসাধনীতেও মিলছে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব।

বর্তমানে মাটি, পানি, বায়ু হয়ে খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে মানব শরীরেও মিলছে প্লাস্টিকের উপস্থিতি। তবুও দিনে দিনে বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। ব্যবহৃত প্লাস্টিকের কিছু অংশ পুনরায় ব্যবহার করা হলেও বেশিরভাগই বর্জ্য হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে সব জায়গায়। তবে এসব প্লাস্টিকের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত পণ্য হচ্ছে পলিথিন।

পলিথিন হচ্ছে রাসায়নিক যৌগ ইথেনের পলিমার, যা বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে তৈরি। এটি একধরনের নমনীয় কিন্তু শক্ত প্লাস্টিক। এমনকি পলিথিন এসিড, ক্ষারসহ অন্যান্য দ্রাবক দ্বারা আক্রান্ত তথা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তাই সাধারণভাবে বলা যায় যে পলিথিন বায়োডিগ্রেডেবল বা পচনশীল নয়।

পলিথিন প্লাস্টিকের তৈরি এমন একটি পণ্য যা শুধু স্বাস্থ্যের জন্য নয় বরং পরিবেশ দূষণেরও অন্যতম প্রধান একটি উপাদান। পলিথিন ব্যবহার করে আমরা সেগুলো যত্রতত্র ফেলে দিই। এটি অপচনশীল হওয়ায় দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে অবিকৃত অবস্থায় থাকে। ফলে মাটিতে সূর্যালোক, পানি ও অন্যান্য উপাদান প্রবেশের অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।

পাশাপাশি অপচনশীল ও ননকম্পোস্টেবল অর্থাৎ সরাসরি হিউমাস বা জৈব সারে পরিণত না হওয়ায় মাটির উর্বরাশক্তি হ্রাস ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরিতেও অন্তরায় হিসেবে কাজ করে এই পলিব্যাগ। এছাড়া জলাবদ্ধতা ও নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ তৈরিতেও এটির ভূমিকা রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের করা এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের তিন প্রধান নদী—পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক ও পলিথিন পড়ে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেও পলিথিনের অবদান কম নয়। পলিথিন উৎপাদনে এবং পুনরায় প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয় তা কারখানার চারপাশের পরিবেশের তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়।

ইউরোপের তুলনায় এশিয়ার দেশগুলোয় পলিথিনের ব্যবহার বেশি এবং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সব থেকে পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বাস্তবে যার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। নিত্যদিনের বাজার করতে গেলেই পলিথিনের দরকার হয়।

আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিদিন পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করছে। প্রায় সব দোকানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে পলিথিনের স্তূপের দেখা মেলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও শোভা পায় পলিথিনের ব্যাগ। অথচ আইন করে সর্বনাশা পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

পলিথিন হচ্ছে রাসায়নিক যৌগ ইথেনের পলিমার, যা বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে তৈরি। এটি একধরনের নমনীয় কিন্তু শক্ত প্লাস্টিক। এমনকি পলিথিন এসিড, ক্ষারসহ অন্যান্য দ্রাবক দ্বারা আক্রান্ত তথা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

দেশে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পর ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়ে যায়, যা মূলত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতের বর্জ্য। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় এক হাজারেরও বেশি পলিথিন কারখানা রয়েছে যেখানে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টন প্লাস্টিক উৎপাদন হচ্ছে। এসব কারখানার সিংহভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক এবং অবৈধ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ঢাকায় বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার শহরাঞ্চলের জাতীয় গড় থেকে তিনগুণেরও বেশি, যা বর্তমানে ২২.২৫ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়, যা পুরো বাংলাদেশে উৎপন্ন বর্জ্যের ১০ শতাংশ। নিষিদ্ধ পলিথিনের কারণে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবেশের।

পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ না করতে পারা বা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। পলিথিনের কতগুলো তথাকথিত সুবিধা রয়েছে যেমন, পলিথিন সবার কাছে অত্যন্ত সহজলভ্য অর্থাৎ চাহিদা মাত্রই পাওয়া যায়। এটি সুলভে পাওয়া যায় বলে দোকানদাররা নিজেদের সাশ্রয়ের জন্য বিপুল পরিমাণে পলিথিন ব্যবহার করে থাকেন। এটি বিনামূল্যে ক্রেতাকে দেওয়া যায় ফলে প্রায় সব দোকানেই এই পলিথিনের বহুল ব্যবহার রয়েছে।

পলিথিনের উৎপাদন খুব সহজ হওয়ায় এর চাহিদা বেশি। সহজে বহন করা যায় বলে এটিকে সবাই পছন্দ করে। এটি সংরক্ষণও খুব সহজ হওয়ায় অনেকদিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। এর বিকল্প হিসেবে আমরা এখনো কোনো সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী পণ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। ভুলে গেলে চলবে না প্লাস্টিকের পণ্য নিজেই বছরের পর বছর ধরে কাঁচের পণ্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

প্লাস্টিক দূষণ রোধে বিশ্বকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না, ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না এবং বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখার নির্দেশ দেন তিনি।

এছাড়া ১ অক্টোবর ২০২৪ থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেন। তিনি আরও বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইএসডিওর সঙ্গে বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি, পাট বা কাপড়ের ব্যাগের উৎপাদনকারীদের নিয়ে একটি মেলার আয়োজন করবে। মেলায় সুপার শপের কর্তৃপক্ষ ও উৎপাদনকারীরা নিজেদের চাহিদা এবং সরবরাহর বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে।’ এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার বৃদ্ধি নয়, এর সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবও প্লাস্টিক সমস্যাকে ঘনীভূত করছে। তাই প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ রোধে সর্বপ্রথম ইংরেজি অক্ষরের তিনটি আর অর্থাৎ রিডিউস বা ব্যবহার কমানো, রিইউজ বা পুনরায় ব্যবহার এবং রিসাইকেল বা পুনরুৎপাদনের প্রতি জোর দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে সার্বিক বিষয়ে নজরদারির জন্য সমন্বয় কমিটি গঠন এবং প্লাস্টিক, পলিথিনের বাজারের ব্যাগ এবং পলিথিনজাত পণ্যের নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধকরণ আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।

চিকিৎসা সরঞ্জাম ছাড়া অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন, ব্যবহার হ্রাস ও প্লাস্টিক বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং এই সংক্রান্ত আইনি কাঠামো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ৬ক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার সব বা যেকোনো প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি অন্য কোনো সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে, এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে।

পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৩ নং আইন) (২০১৩ সনের ৩৮ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ধারা-৪ পণ্য সামগ্রীতে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার কোনো ব্যক্তি বিধি দ্বারা নির্ধারিত পণ্য, পাটজাত মোড়ক দ্বারা মোড়কজাতকরণ ব্যতীত, বিক্রয়, বিতরণ বা সরবরাহ করতে পারবে না।

বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বাস্তবে যার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিদিন পলিথিন প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করছে।

প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি ও প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যের শুল্ক হ্রাস করা। বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানিকৃত পলি প্রোপাইলিন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিসে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। প্লাস্টিক বোতলে পানি বা কোমল পানি তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলো প্লাস্টিক বোতল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিধায় সিএসআর এর আওতায় তাদের লভ্যাংশ থেকে একটা অংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা।

প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে সামাজিক জাগরণ তৈরি করা। দেশের পর্যটন স্পটগুলোয় প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে ট্যুরিস্ট পুলিশসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজরদারি জোরদার করা। নগর এলাকায় পলিথিনমুক্ত বাজারের মডেল তৈরি করা। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে গণ সচেতনতামূলক টিভিসি প্রচার ও সুপারশপসহ বড় বড় বাজারগুলোর সামনে বিল বোর্ড স্থাপন করে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা।

পরিবেশ অধিদপ্তর, পাট অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। সর্বোপরি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কার্যকর ভূমিকাই পারে পলিথিনের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।

এখন কাগজ, পাট, তন্তু, পাতা ও কাপড়ের ব্যাগের ব্যবহারই আমাদের পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে পরিবেশকে সুরক্ষা দিতে পারে। পাটের সোনালি ব্যাগ পরিবেশবান্ধব ও দামে সাশ্রয়ী। পাটের ও কাগজের ব্যাগের ইতিবাচক দিক, সাশ্রয়ী দাম ও সহজে প্রাপ্তির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ সুরক্ষায় একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়া দরকার।

আমরা সবাই মিলে একযোগে সমন্বিতভাবে যদি সরকারের পাশাপাশি নিজেরাও পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করি তবেই আমাদের এই সবুজ শ্যামল সুন্দর বাংলাদেশকে আমরা পলিথিন দূষণ থেকে রক্ষা করতে পারবো।

অধ্যাপক . আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ।। ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ