টাইপ-১ ডায়াবেটিসের মতো গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ইনসুলিনের অপর্যাপ্ততার কারণে হয় না। বরং গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল হতে তৈরি কিছু হরমোন মায়ের শরীরের স্বাভাবিক ইনসুলিনের কার্যক্ষমতাকে ব্যাহত করে। ফলে শরীরের উৎপাদিত গ্লুকোজের শোষণ মাত্রা কমে যায় এবং বাড়ে রক্তের গ্লুকোজ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো প্রসব পরবর্তীকালে দৃশ্যমান থাকে না বা নিরাময় হয়ে যায়।
* কারণ
যদিও গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সঠিক কারণ এখনো অজানা। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাসেন্টা, গর্ভফুল হতে নিঃসৃত কিছু হরমোন, যেমন-ইস্ট্রোজেন, কটিসোল, হিউম্যান প্লাসেন্টাল ল্যাকটোজেন গর্ভকালীন মায়ের শরীরের স্বাভাবিক ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যা সাধারণত প্রকট হয় গর্ভকালীন ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে এবং তা পরে গর্ভফুলের প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এসব হরমোনের নিঃসরণ মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। একইসঙ্গে বৃদ্ধি পেতে থাকে ইনসুলিনের অকার্যকারিতা। সাধারণত এ সময়ে মায়েদের অগ্নাশয়, যেখান থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়, তা এ অকার্যকর ইনসুলিনের অভাব পূরণে দেহে বেশি ইনসুলিনের নিঃসরণ ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু এরপরও ইনসুলিন অপর্যাপ্ত থেকে যায়। তখনই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়ে আর গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
* কীভাবে ঝুঁকি বাড়ে
▶ ওজনাধিক্য বা স্থূলতা।
▶ ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস।
▶ গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের আগের ইতিহাস।
▶ পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম।
▶ পূর্ববতীতে অধিক ওজনের সন্তান প্রসব।
▶ গর্ভকালীন মায়ের বয়স ২৪ বছর বা তার চেয়ে বেশি হলে ও উচ্চরক্তচাপ, রক্তে উচ্চহারে চর্বি, হৃদরোগের বা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগের ইতিহাস।
* কীভাবে ও কখন নির্ধারণ করা হয়
প্রত্যেক গর্ভবতী মায়ের বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিসের যে কোনো বিপজ্জনক বা ঝুঁকি অবস্থার ইতিহাস আছে, তাদের প্রথম চেক-আপেই ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করা উচিত। অন্যদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে ওজিটিটি বা ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট করা হয় ডায়াবেটিস নির্ধারণের জন্য। যেখানে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা না খেয়ে সকালে খালি পেটে ও পরে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজের পানি খেয়ে দুই ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার পরিমাণ দেখে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ধারণ হয়।
* চিকিৎসা
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ধারণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সুস্থ মা ও বাচ্চার সুস্থতার জন্য একজন প্রসূতি বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞেরও পরামর্শ নিতে হবে। পাশাপাশি একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালরি মেপে খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। প্রসব পরবর্তীকালে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নিতে হবে। রক্তের স্বাভাবিক শর্করার পরিমাণ বজায় রাখার জন্য একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ সুনিয়ন্ত্রিত খাদ্য তালিকা, প্রয়োজনীয় ব্যায়াম ও দৈনিক রক্তের সুগার পরিমাপের পরামর্শ দেন। চিকিৎসক রক্তের সুগার স্বাভাবিক রাখার প্রয়োজনে ইনসুলিন দিয়ে থাকেন। নিরাপদ প্রসব ও অনাগত বাচ্চার সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রত্যেক মায়েরই রক্তে সুগার খালি পেটে ৫.৩ মিলিমোল/লিটার বা তার নিচে ও খাবারের ২ ঘণ্টা পর ৬.৭ মিলিমোল/লিটার বা তার নিচে রাখতে হবে। অর্থাৎ ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে প্রসব পরবর্তী সময় প্রত্যেক মাকেই তার ডায়াবেটিসের মাত্রা চেক করতে হবে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে সব গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মায়েদেরই উচিত কমপক্ষে প্রতি তিন বছরে একবার রক্তে শর্করা চেক করা। একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মা সুনিয়ন্ত্রিত খাদ্যতালিকা, নিয়মিত ব্যায়াম, আদর্শ শারীরিক ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তার পরবর্তীতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে পারেন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হরমোন ও ডায়াবেটিস বিভাগ, মার্কস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মিরপুর, ঢাকা।