তারেকুর রহমান, কক্সবাজার ||
কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে ৬-৭ কিলোমিটার গেলেই হিমছড়ি সৈকত। একসঙ্গে পাহাড়-সমুদ্রের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ কেবল এখানেই মেলে। শুধু হিমছড়ি নয়, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত ১২০ কিলোমিটার বালুকাময় সৈকতে রয়েছে পর্যটকদের বিমোহিত করার অসাধারণ অনেক স্পট। কিন্তু শহরের লাবণী থেকে কলাতলী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার ছাড়া অন্য কোথাও গোসলে নামা পর্যটকদের উদ্ধারে নেই লাইফগার্ড কিংবা ডুবুরি দল। এতে ভ্রমণে এসে অনেক পর্যটক অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
গত ৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী পরীক্ষা শেষে ঘুরতে এসেছিলেন হিমছড়ি সৈকতে। সকালে গোসলে নেমে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যান তিনজন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার হলেও, সিলেটের বিয়ানীবাজারের শিক্ষার্থী অরিত্র হাসান এখনও নিখোঁজ। আড়াই মাসেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অরিত্রের বাবা সাকিব হাসান দ্য ডেইলি নিউএজ পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক। তিনি দরিয়ানগরকে বলেন, “অসাধারণ সুন্দর জায়গা হিমছড়ি। পর্যটক আসবেন, গোসলে নামবেন—এটাই স্বাভাবিক। অথচ এমন জায়গায় পর্যটকদের উদ্ধার করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা খুবই হতাশাজনক।”
চলতি বছর সৈকতে গোসলে নেমে গুপ্তখালে আটকা পড়ে সাগরে ভেসে গিয়ে ইতোমধ্যেই ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বছরই মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যেই শহরে চালু থাকা একমাত্র লাইফগার্ড সেবাটিও তহবিল সংকটে আগামী ১ অক্টোবর থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের প্রধান এই পর্যটনকেন্দ্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
১২ বছরের সেবা শেষে বন্ধ হচ্ছে সি-সেফ লাইফগার্ড
২০১২ সালে আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা ‘রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট’ (আরএনএলআই)-এর অর্থায়নে কক্সবাজারের লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে চালু হয় সি-সেফ লাইফগার্ড সেবা। গত ১২ বছরে তারা ৮১৫ জন পর্যটকের প্রাণ বাঁচিয়েছে। এ সময়ে সাগরে ভেসে যাওয়া ৬৫টি মরদেহ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে।
সি-সেফ লাইফগার্ড আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, তাদের ২৭ জন লাইফগার্ডসহ মোট কর্মী সংখ্যা ৩৫। সেবা চালাতে প্রতি মাসে খরচ হয় প্রায় ১৪ লাখ টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও দাতা সংস্থা প্রথমে ছয় মাস এবং পরে আরও তিন মাস সময় বাড়ায়। কিন্তু নতুন করে অর্থের জোগান না হওয়ায় ৩০ সেপ্টেম্বরের পর সেবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, “লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হওয়ার বিষয়টি পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে সৈকত এলাকার হোটেল, রিসোর্ট ও গেস্টহাউসগুলোর মাধ্যমে সেবা চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হোটেল মালিকদের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।”
চাকরি হারাচ্ছেন ২৭ লাইফগার্ড কর্মী
লাবণী পয়েন্টের ওয়াচ টাওয়ারে দায়িত্ব পালন করছিলেন লাইফগার্ড আবদু শুক্কুর (৩৫)। প্রায় ১২ বছর ধরে কখনও টাওয়ারে, কখনও বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি পর্যটকদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। বিপদে পড়া অসংখ্য পর্যটককে উদ্ধারের স্মৃতি তার মনে জড়িয়ে আছে।
তিনি বলেন, “এই কাজ ছাড়া আমি আর কোনো কাজে দক্ষ নই। কাজটি বন্ধ হয়ে গেলে কিভাবে পরিবার চালাব, তা ভেবে পাচ্ছি না।”
সি-সেফ সুপারভাইজার মোহাম্মদ ওসমান জানান, “প্রতিদিন সাগরে ঘুরে বেড়িয়ে পর্যটকদের জীবন বাঁচিয়েছি। জীবন বাঁচাতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু চাকরি হারিয়ে এখন আমাদের নিজেদের জীবন কীভাবে চলবে, সেই চিন্তায় আছি।”
সরকারি উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি
বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র। প্রতিবছর ৫০ লাখেরও বেশি দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন। তাদের বড় অংশই সমুদ্রের নোনাজলে গা ভেজান।
কক্সবাজার সার্ফ গার্লস অ্যান্ড বয়েজ ক্লাবের সভাপতি মো. রাশেদ আলম বলেন, “এমন গুরুত্বপূর্ণ সেবা শুধু এনজিওর ওপর নির্ভর করে চালানো সম্ভব নয়। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি বাজেট ও প্রশাসনিক সহায়তা ছাড়া এটি টেকসই হবে না।”
যশোর থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক আরিফুল ইসলাম বলেন, “লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হলে পর্যটকের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। এতে পর্যটনশিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।”
কক্সবাজার হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, “মাসে ১৪-১৫ লাখ টাকা জোগাড় করা হোটেল মালিকদের জন্য কঠিন। তাই তাদের সাড়া খুব একটা নেই।”
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি সৈকতে চেয়ার-ছাতা, দোকান, বিচ বাইক, লকারসহ নানা খাত থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব পায়। সেখান থেকে অর্থ ব্যয় করে লাইফগার্ড সেবা চালু রাখা সম্ভব।