ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক সময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হতো। এখনো অনেকে বলেন। আমিও বলেছি। আমার বাবা এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২২ সালে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর আমরা সব ভাইবোন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি, সবাই এখান থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি পেয়েছি। আমি গর্ব করে বলতাম, আমাদের পরিবারের সবাই প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের ছাত্র। আমার সেই গর্ব গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
আমার গর্ব কেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল? আমার মাথা কেন নত হয়ে গেল? কে বা কারা এর জন্য দায়ী? পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সেই নৃশংস ঘটনার কথা বলছি। তোফাজ্জল হোসেন নামে এক নিরীহ-নিরপরাধ যুবককে বুধবার রাতে হলের গেস্টরুমে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যা করেছে সেই হলেরই ছাত্র নামধারী একদল দুর্বৃত্ত।
বরগুনার অধিবাসী তোফাজ্জল ছিল মেধাবী ছাত্র। মাস্টার্স ডিগ্রিও অর্জন করেছিল। অল্প সময়ের ব্যবধানে তার বাবা, মা ও একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুতে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভবঘুরে হয়ে যায়। কোথায় থাকে, কোথায় যায়, কী খায়-কেউ বলতে পারত না। শেষ পর্যন্ত তাকে দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। মানুষের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিত, খাবার নিত, ফুটপাতে শুয়ে থাকত।
ক্ষুধার্ত তোফাজ্জল সেদিন ঘুরতে ঘুরতে ফজলুল হক হলের মাঠে ঢুকে পড়ে। হলের কতিপয় আবাসিক ছাত্র তাকে চোর অপবাদ দিয়ে গেস্টরুমে নিয়ে যায় এবং মারতে থাকে। তখন রাত ৮টার মতো বাজে। এরপর শুরু হয় গণপিটুনি। ঘণ্টাখানেক পেটানোর পর তাকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে ভাত খেতে দেওয়া হয়। খাওয়ানোর পর আবার শুরু হয় গণপিটুনি। সংবাদপত্রের খবরে জানা যায়, দ্বিতীয় দফা মারধরের সময় ২৫/৩০ জন অংশ নেয়। এদের অনেকের হাতে ছিল ক্রিকেট স্টাম্প, হকিস্টিক, লাঠি ইত্যাদি। আরও এক ঘণ্টা পিটিয়ে রক্তাক্ত করার পর তোফাজ্জল অজ্ঞান হয়ে যায়। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার অনেকক্ষণ পরে কয়েকজন আবাসিক শিক্ষক তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতালে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একটি সংবাদপত্রে দেখলাম, তাকে রাত ১২টায় হাসপাতালে পাঠানো হয়। তাকে যখনই হাসপাতালে নেওয়া হোক, অনেক বিলম্ব হয়েছে সন্দেহ নেই।
এখানে প্রশ্ন থাকে, আবাসিক শিক্ষকরা এত দেরিতে ঘটনাস্থলে এলেন কেন? ঘটনার যখন শুরু, অর্থাৎ রাত ৮টা, তখনই আসার কথা। হলের দারোয়ান, কর্মচারী, ক্যান্টিনের লোক, কেউ কি দেখেননি এমন একটা নৃশংস ঘটনা ঘটছে? তারা যদি সঙ্গে সঙ্গে আবাসিক শিক্ষক, প্রভোস্ট বা পুলিশকে খবর দিতেন, তাহলে তোফাজ্জলের প্রাণটা বেঁচে যেত, হলটি কলঙ্কিত হতো না। তোফাজ্জলের মৃত্যু ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য ঘাতক ছাত্ররা ছাড়াও হল কর্তৃপক্ষ, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। এটাকে এক কথায় বলা যায় শৃঙ্খলার অভাব। ফজলুল হক হলে শৃঙ্খলা নেই, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলেও কি আছে? ‘কোমলমতি’ ছাত্ররা তো সব হলেই থাকে।
এ হত্যাকাণ্ডের পর হল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে আটজন অপরাধীকে শনাক্ত করেছে। এদের মধ্যে ছয়জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অন্য দুজন ধরা পড়েনি। গ্রেফতারকৃতরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা আরও ১০/১৫ জনের নাম বলেছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। অথচ হলের তদন্ত কমিটি মাত্র আটজনের নাম বলেছে। অন্যরা কোথায় গেল? টেলিভিশনের সংবাদ বুলেটিনে প্রচারিত ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে আমরা দেখেছি অন্তত ১৫/২০ জন তোফাজ্জলকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে, আঘাতের পর আঘাত করছে। অথচ তদন্ত কমিটি মাত্র আটজনকে শনাক্ত করল?
ওই একই দিনে, অর্থাৎ বুধবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দফা গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বুধবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত চার দফা বেধড়ক পিটিয়ে তাকে গুরুতর আহত করা হয়। শেষবার তাকে উদ্ধার করে পুলিশের গাড়িতে তোলার পরও পেটানো হয়। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আটজনকে দায়ী বলে চিহ্নিত করেছে। এই আটজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং কমিটিকে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলেছে। এত সময় কেন লাগবে বোঝা গেল না। পুলিশ কী ব্যবস্থা নিয়েছে জানা যায়নি, কারণ সংবাদপত্রে এ সম্পর্কিত কোনো খবর দেখিনি।
তোফাজ্জল হোসেনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে যখন লিখছি, তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) আবরার হত্যাকাণ্ডের কথা মনে পড়ে গেল। আবরার ফরহাদ রাব্বি ছিল বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সে থাকত বুয়েটের শেরে বাংলা ছাত্রাবাসে। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে তাকে হলের একটি কক্ষে সারা রাত লাঠি, ক্রিকেট স্টাম্প ইত্যাদি দিয়ে পেটানো হয়। তাকে যারা মেরেছিল, তারা ছাত্রলীগের সুপরিচিত নেতাকর্মী। তাদের প্রায় সবাইকে চিহ্নিত ও গ্রেফতার করা হয়।
আবরার হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্তদের বিচার হয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর বিচারের রায় ঘোষণা হয়। বিচারে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে বলে শুনিনি। রায় কার্যকর করতে উচ্চতর আদালতের অনুমোদন লাগে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকাণ্ডের কথাও উল্লেখ করতে হয়। ২৪ বছর বয়সি বিশ্বজিৎ দাস দর্জি দোকানের কর্মচারী ছিল। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের পাশে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীরা সবাই ছিল ছাত্রলীগ কর্মী। সেদিন ছিল বিরোধী দলের ডাকা হরতাল। হত্যাকারীরা পথচারী বিশ্বজিৎকে শিবিরকর্মী বলে সন্দেহ করে এবং কুপিয়ে মারে। এ ঘটনায় মামলা ও অভিযুক্তদের বিচার হয়। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার আদালত আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। পরবর্তীকালে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট দুজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এ রায় কার্যকরের খবর পাওয়া যায়নি। সম্ভবত মামলাটি আপিল বিভাগে আছে।
গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আগেও ঘটেছে এবং এখন আরও বেশি ঘটছে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে বলা হচ্ছে ‘মব জাস্টিস’ বা ‘মব ট্রায়াল’। হত্যাকাণ্ডকে এ ধরনের সংজ্ঞা দিলে ঘটনার গুরুত্ব অনেকটাই কমে যায় বলে আমি মনে করি। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকেও ‘মব জাস্টিস’ বলে ঘটনার গুরুত্ব কমানো বা হালকা করার সুযোগ থাকবে। গণপিটুনি বা অন্য যে কোনোভাবে কাউকে মেরে ফেললে সেটা হত্যাকাণ্ডই হবে এবং সেটার বিচার হতে হবে মার্ডার বা হত্যা হিসাবে। মানবাধিকার সংগঠন বা অধিকার কর্মীরা আমাদের দেশে কিছু ঘটলেই হইচই শুরু করেন। আন্দোলন করেন। এখন তারা চুপচাপ কেন?
এ লেখার শুরুতে বলেছিলাম, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার গর্ব চুরমার হয়ে গেছে। এখন আমার আরেকটি আশঙ্কার কথা বলে লেখা শেষ করতে চাই। সেটা হচ্ছে, আমি কি আমার প্রিয় প্রাঙ্গণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আর যেতে পারব? যদিও আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন ছাত্র নই, কিন্তু সাবেক ছাত্র তো বটে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন Dhaka University Alumni Association (DUAA)-এর আজীবন সদস্য। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠনেরও আমি সদস্য। এ দুই সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আমাকে ক্যাম্পাসে যেতে হয়। আমি আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়েই যাই। কিন্তু আর কি যেতে পারব? বহিরাগত বলে গণপিটুনির শিকার হলে কেউ কি আমাকে রক্ষা করতে পারবেন? এমন একটা আতঙ্ক আমাকে জাপটে ধরেছে।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com
[btn_block id=800]