বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবল খেলবে, এটা নব্বই দশকের দিকেও অনেকে চিন্তা করতে পারেনি। অবশ্য, আরও আগে সেই ১৯৭৭ সালে দেশসেরা ফুটবল শিক্ষক সাহেব আলীর তত্ত্বাবধানে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বেশ কয়েকজন মেয়েকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন চলার পর আর্থিক সংকটে সেটা আর ধারাবাহিকতাভাবে চলতে পারেনি। ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ নারী ফুটবল দল হঠাৎ করেই বাংলাদেশে আসে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে। কিন্তু তখন বাংলাদেশ নারী ফুটবল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু হয়নি। যশোরে তারা দুভাগে বিভক্ত হয়ে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে। সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের কয়েকজন খেলোয়াড়।
পশ্চিমবঙ্গ মহিলা দলের নেত্রকোনায় খেলার কথা থাকলেও কট্টরপন্থিদের বাধার মুখে তা হয়নি।
ঢাকা মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে অনেকটা গোপনে গোমেজ, ডালিয়াসহ বাংলাদেশের পাঁচজন মেয়ে এবং পশ্চিমবঙ্গের সাইড বেঞ্চে থাকা ফুটবলারদের নিয়ে বাফুফে একাদশ গঠন করা হয়। ওই দলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ দল প্রীতি ম্যাচ খেলে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলে আগ্রহী করে তোলা। বাংলাদেশে মহিলা ফুটবল চালুর ব্যাপারে ফিফা-এএফসির কিছু তাগাদাও ছিল। ২০০৩ সালের শুরুর দিকে আমি বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকা হিসাবে বাফুফেকে বিষয়টি জানাই যে, আমরা নারী ফুটবলচর্চায় অবদান রাখতে চাই, সহযোগিতা করতে চাই। বাফুফের তৎকালীন সহসভাপতি সিরাজুল ইসলাম বাচ্চুকে চেয়ারম্যান এবং আমাকে সম্পাদিকা করে ১৫ সদস্যের মহিলা কমিটি গঠন করা হয়। শুরু হয় আমাদের নারী ফুটবলের আনুষ্ঠানিক পথচলা। সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে উন্মুক্ত ট্রায়ালে প্রায় ৭০ জন খেলোয়াড় যোগ দেয়। সেখান থেকে ৪০ জনকে বাছাই করে দুমাস ক্যাম্প চলে। পরে সফিপুর আনসার একাডেমিতে চলে আরেকটি ক্যাম্প। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রামপ্রতিরক্ষা দল আমাদের দেশে নারী ফুটবল প্রবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। আনসারের তৎকালীন ক্রীড়া অফিসার মো. আলম নারী ফুটবলের উন্নয়নে ব্যাপক সহযোগিতা করেছেন। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান থেকে খেলোয়াড় হান্ট করতে থাকেন। পার্বত্য অঞ্চলের মেয়েরা একটু বেশি পরিশ্রমী হওয়ায় তারা ছিল আনসারের প্রথম পছন্দ। প্রথমদিকে নারী ফুটবলের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন মরহুম কাজী সাত্তার ও মো. চান। পরে মোশাররফ বাদল ও বড় ইউসুফ দলের হাল ধরেন।
২০০৪ সালের ৪-১৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ব্যবস্থাপনায় দেশে প্রথমবার মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়। মাত্র ছয়টি জেলা নিয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম মহিলা টুর্নামেন্ট। চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা জেলা। ফাইনালে তারা বাংলাদেশ আনসার দলকে ১-০ গোলে হারায়। শ্রাবণী পোদ্দার প্রথম গোলদাতা হিসাবে নিজের নাম লেখান ইতিহাসের পাতায়। ২০০৫ সালের মে মাসে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলকে আমন্ত্রণ জানায়। বাচ্চু ভাই, আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। মাত্র দুই বছর বয়স নারী ফুটবলের। অনুশীলনও মাত্র চার-পাঁচ মাসের বেশি হবে না। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রেল, যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ মুখার্জির সহযোগিতায় বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দলকে তারা আমন্ত্রণ জানায়। উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যাম হে সিটিতে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ নারী ফুটবল খেলতে যাওয়ার আগে তাদের ভয় দূর করা। বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবল খেলছে, তাতেই তখন আনন্দিত দর্শকরা। প্রচুর সমর্থন এবং উৎসাহ পায় আমাদের মেয়েরা। ফিরে এসে এক সপ্তাহ পরেই কোরিয়ায় যাত্রা। কোরিয়ায় বাংলাদেশ খেলে তিনটি দেশের সঙ্গে। এশিয়ার পরাশক্তি জাপানের কাছে অনেক গোলের ব্যবধানে হারতে হয়েছিল (২৬-০)। গুয়ামের কাছে ১-০ এবং হংকংয়ের কাছে ২-১ গোলে হারে মেয়েরা। অভিজ্ঞতার অভাবেই হংকং এবং গুয়ামের কাছে হারতে হয়েছিল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলকে। বাংলাদেশ দল হারলেও সব কর্মকর্তা ভূয়সী প্রশংসা করেন আমাদের। আমি গিয়েছিলাম দলনেতা কাম ম্যানেজার হিসাবে। এএফসি কর্মকর্তাকে বলেছিলাম, এত অল্প সময়ের অনুশীলনে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের পারফরম্যান্সে আমরা সন্তুষ্ট। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের মে মাসে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ কোয়ালিফায়ার রাউন্ডে বাংলাদেশ নারী দল খেলতে যায় ভারতের দিল্লিতে। কোয়ালিফাই না হলেও বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স ছিল আশাব্যঞ্জক।
কলকাতার ফুটবল কর্মকর্তা দেবু মুখার্জি রেলমন্ত্রী সুভাষ চ্যাটার্জি মাধ্যমে কলকাতায় চারটি প্রদর্শনী ম্যাচের যাবতীয় আয়োজন করে দেন। মোহামেডান কর্মকর্তা আবু হাসান চৌধুরী প্রিন্সও সেসময় অনেক সহযোগিতা করেছেন।
তখন দেশে ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য বড় বড় স্পন্সর কোম্পানির কাছে গিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি। তারা বলত, নারী ফুটবলে স্পন্সর করলে কট্টরপন্থিরা আমাদের অফিস ভাঙচুর করবে। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে তখন নারী ফুটবলের জন্য কাজ করতে হয়েছে। ফুটবল ফেডারেশনও আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে পারেনি। আমি তখন বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থারও সাধারণ সম্পাদিকা। কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে ২০০৬ সালে আয়োজন করলাম প্রথম আন্তঃজেলা নারী ফুটবল প্রতিযোগিতা। এবারের প্রতিযোগিতায় পেলাম আমরা আটটি জেলা। ফুটবল ফেডারেশন আয়োজিত প্রথম আসরের চেয়ে দুটি জেলা বেশি। শুধু স্পন্সর ছাড়াই বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ছয় লাখ টাকার বাজেটে বেশ জমজমাটভাবে অনুষ্ঠিত হলো টুর্নামেন্ট।
তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজন করে দ্বিতীয় আন্তঃজেলা নারী ফুটবল প্রতিযোগিতা। সেবারও অংশ নেয় আটটি জেলা দল।
কামরুন নাহার ডানা : বাফুফের নারী ফুটবল কমিটির প্রথম সম্পাদিকা